পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ 8O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী দেখতে গিয়েছিলেম তার গল্পাংশটাকে টাইপ করে আমাদের হাতে দিয়েছিল । সেটা পাঠিয়ে দিচ্ছি, পড়ে দেখো । মূল মহাভারতের সঙ্গে মিলিয়ে এটা বাংলায় তর্জমা করে নিয়ো । এ গল্পের বিশেষত্ব এই যে, এর মধ্যে দ্ৰৌপদী নেই। মূল মহাভারতের ক্লাব বৃহন্নলা এই গল্পে নারীরূপে ‘কেন-বদি’ নাম গ্ৰহণ করেছে । কীচক একে দেখেই মুগ্ধ হয় ও ভীমের হাতে মারা পড়ে । এই কীচক জাভানি মহাভারতে মৎস্যপতির শত্ৰু, পাণ্ডবেরা একে বধ করে বিরাটের রাজার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছিল। আমি মন্ধুনগরো-উপাধিধারী যে-রাজার বাড়ির অলিন্দে বসে লিখছি। চারি দিকে তার ভিত্তিগাত্রে রামায়ণের চিত্র রেশমের কাপড়ের উপর অতি সুন্দর করে অঙ্কিত । অথচ ধর্মে ঐরা মুসলমান । কিন্তু, হিন্দুশাস্ত্রের দেবদেবীদের বিবরণ এরা তন্ন তন্ন করে জানেন । ভারতবর্ষের প্রাচীন ভু-বিবরণের গিরিনদীকে ঐরা নিজেদের দেশের মধ্যেই গ্ৰহণ করেছেন । বস্তুত, সেটাতে কোনো অপরাধ নেই, কেননা রামায়ণ-মহাভারতের নরনারীরা ভাবমূর্তিতে এদের দেশেই বিচরণ করছেন ; আমাদের দেশে তাদের এমন সর্বজনব্যাপী পরিচয় নেই, সেখানে ক্রিয়াকর্মে উৎসবে আমোদে ঘরে ঘরে তারা এমন করে বিরাজ করেন না । আজ রাত্রে রাজসভায় জাভানি শ্রোতাদের কাছে আমার ‘কথা ও কাহিনী’ থেকে কয়েকটি কথা আবৃত্তি করে শোনাব। একজন জাভানি সেগুলি নিজের ভাষায় তর্জমা করে ব্যাখ্যা করবেন । কাল সুনীতি ভারতীয় চিত্ৰকলা সম্বন্ধে দীপচিত্র সহযোগে বক্তৃতা করেছিলেন । আজ আবার তাকে সেইটে বলতে রাজা অনুরোধ করেছেন । ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সব কথা জানতে এদের বিশেষ আগ্রহ। ইতি ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ * 2 ܠ রথী, শূরকর্তার মকুনগরের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে যোগ্যকর্তায় পাকোয়ালাম-উপাধিধারী রাজার প্রাসাদে আশ্রয় নিয়েছি। শূরকর্তা শহরে একটি নতুন সঁাকো ও রাস্তা তৈরি শেষ হয়েছে, সেই রাস্তা পথিকদের ব্যবহারের জন্যে মুক্ত করে দেবার ভার আমার উপরে ছিল । সঁাকোর সামনে রাস্তা আটকে একটা কাগজের ফিতে টাঙানো ছিল, কঁচি দিয়ে সেটা কেটে দিয়ে পথ খোলসা করা গেল । কাজটা আমার লাগল ভালো ; মনে হল, পথের বাধা দূর করাই আমার ব্ৰত । আমার নামে এই রাস্তার নামকরণ হয়েছে । পথে আসতে পেরাম্বান বলে এক জায়গায় পুরোনো ভাঙা মন্দির দেখতে নামলিম । এ জায়গাটা ভুবনেশ্বরের মতো, মন্দিরের ভগ্নস্তুপে পরিকীর্ণ । ভাঙা পাথরগুলি জোড়া দিয়ে দিয়ে ওলন্দাজ গবর্মেন্ট মন্দিরগুলিকে তার সাবেক মূর্তিতে গড়ে তুলছেন । কাজটা খুব কঠিন, অল্প অল্প করে এগোচ্ছে ; দুই-একজন বিচক্ষণ যুরোপীয় পণ্ডিত এই কাজে নিযুক্ত । তাদের সঙ্গে আলাপ করে বিশেষ আনন্দ পেলুম । এই কাজ সুসম্পূৰ্ণ করবার জন্যে আমাদের পুরাণগুলি নিয়ে ঐরা যথেষ্ট আলোচনা করছেন । অনেক জিনিস মেলে না, অথচ সেগুলি যে জাভানি লোকের স্মৃতিবিকার থেকে ঘটেছে তা নয়, তখনকার কালের ভারতবর্ষের লোকব্যবহারের মধ্যে এর ইতিহাস নিহিত । শিবমন্দিরই এখানে প্রধান । শিবের নানাবিধ নাট্যমুদ্রা এখানকার মূর্তিতে পাওয়া যায়, কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে তার বিস্তারিত সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না । একটা জিনিস ভেবে দেখবার বিষয় । শিবকে এ দেশে গুরু, মহাগুরু বলে অভিহিত করেছে। আমার বিশ্বাস, বুদ্ধের গুরুপদ শিব অধিকার করেছিলেন ; মানুষকে তিনি মুক্তির শিক্ষা দেন । এখানকার শিব নটরাজ, তিনি মহাকাল অর্থাৎ সংসারে যে চলার প্রবাহ, জন্মমৃত্যুর যে ওঠাপড়া, সে তারই নাচের ছন্দে ; তিনি ভৈরব, কেননা, তার লীলার অঙ্গই হচ্ছে মৃত্যু | ১ অমিয়চন্দ্ৰ চক্রবতীকে লিখিত ।