পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ‘রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী • কাল রাত্রে এক জায়গায় গিয়েছিলুম জটায়ুবিধের অভিনয় দেখতে । দেখে এ দেশের লোকের মনের একটা পরিচয় পাওয়া যায় । আমরা যাকে অভিনয় বলি তার প্রধান অংশ কথা, বাকি অংশ হচ্ছে নানাপ্রকার হৃদয়ভাবের সঙ্গে জড়িত ঘটনাবলীর প্রতিরূপ দেখানো । এখানে তা নয় । এখানে প্ৰধান জিনিস হচ্ছে ছবি এবং গতিচ্ছন্দ । কিন্তু, সেই ছবি বলতে প্ৰতিরীপ নয়, মনোহর রূপ । আমরা সংসারে যে দৃশ্য সর্বদা দেখি তার সঙ্গে খুব বেশি অনৈক্য হলেও এদের বাধে না । পৃথিবীতে-মানুষ উঠে দাড়িয়ে চলাফেরা করে থাকে । এই অভিনয়ে সবাইকে বসে বসে চলতে ফিরতে হয় । সেও সহজ চলাফেরা নয়, প্রত্যেক নড়াচড়া নাচের ভঙ্গিতে । মনে মনে এরা এমন একটা কল্পলোক সৃষ্টি করেছে যেখানে সবাই বসার অবস্থায় নেচে বেড়ায় । এই পঙ্গু মানুষের দেশ যদি প্রহসনের দেশ হত তা হলেও বুঝতুম । একেবারেই তা নয়, এ মহাকাব্যের দেশ । এরা স্বভাবকে খাতির করতে চায় না । স্বভাব তার প্রতিশোধস্বরূপে যে এদের বিদ্রুপ করবে, এদের হাস্যকর করে তুলবে, তাও ঘটল না । স্বভাবের বিকারকেও এরা সুদৃশ্য করবে, এই এদের পণ । ছবিটাই এদের লক্ষ্য, স্বভাবের অনুকরণ এদের লক্ষ্য নয়, এই কথাটা এরা যেন স্পর্ধার সঙ্গে বলতে চায় । মনে করো-না কেন, প্ৰথম দৃশ্যটা রাজসভায় দশরথ ও তার অমাত্যবৰ্গ । রঙ্গভূমিতে এরা সবাই গুড়ি মেরে প্রবেশ করল । মনে হয়, এর চেয়ে অদ্ভুত কিছুই হতে পারে না। ব্যাপারটাকে হাস্যকরীতা থেকে বাচানো কত কঠিন ভেবে দেখো । কিন্তু, এতে আমরা বিরূপ কিছুই দেখলুম না, এরা দশরথ কিংবা রাজামাত্য সে কথাটা সম্পূৰ্ণ গৌণ হয়ে গেল । পরের দৃশ্যে কৈকেয়ী প্ৰভৃতি রানী আর সখীরা তেমনি করেই বসা-অবস্থায় হেলে দুলে নেচে নেচে প্ৰবেশ করলে । আট-নয় বছরের ছেলেরা সব কৌশল্যা প্ৰভৃতি রানী সেজেছে । এদিকে কৌশল্যার ছেলে রাম যে সেজেছে তার বয়স অন্তত পঁচিশ হবে ; এটা যে কত বড়ো অসংগত সে প্রশ্ন কারও মনেই আসে না, কেননা, এরা দেখছে ছবির নাচ । যতক্ষণ সেটাতে কোনো দোষ ঘটছে না। ততক্ষণ নালিশ করবার কোনো হেতু নেই । অন্য দেশের লোকেরা যখন জিজ্ঞাসা করে, এর মানে কী হল, এরা বলে, “তা আমরা জানি নে, কিন্তু আমাদের “রসম তৃপ্ত হচ্ছে।” অর্থাৎ, মানে না পাই রাস পাচ্ছি। আমাকে একজন ওলন্দাজ পণ্ডিত বলছিলেন, বালির লোকেরা অভ্যাসমত যে-সব পূজানুষ্ঠান করে তার মানে তারা কিছুই বোঝে না। কিন্তু তারাও “রসম-তৃপ্তির দোহাই দিয়ে থাকে । অর্থাৎ, যখন সাড়া পায় তখন তাদের যে আনন্দ তাকে তো আধ্যাত্মিক বলা যেতে পারে । কাল রাত্রে এই রঙ্গক্ষেত্রের বহিরঙ্গনে কত যে লোক জমেছে তার সংখ্যা নেই । নিঃশব্দে তারা দেখছে ; শুধু কেবল দেখারই সুখ । তাদের মনের মধ্যে রামায়ণের গল্প আছে, সেই গল্পের ধারার সঙ্গে ছবির ধারা মিলে কল্পনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে । এর মধ্যে আশ্চর্যের বিষয়টা হচ্ছে এই যে, যে-ছবিটা দেখছে সেটাতে গল্পকে ফুটিয়ে তোলবার কোনো চেষ্টা নেই। রামের যৌবরাজ্যে কৈকেয়ী রাগ করেছে ; কিন্তু যেরকম ভাবভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে আমাদের চোখে কানে রাগের ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ছবির মধ্যে তার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না । আট-দশ বছরের ছেলে স্ত্রীবেশে কৈকেয়ী সাজলে তার মধ্যে কৈকেয়ীত্ব লেশমাত্র থাকা অসম্ভব । তবু এরা তাতে কোনো অভাব বোধ করে না । জিনিসটা যদি আগাগোড়া ছেলেমানুষি ও গ্রাম্য বর্বর-গোছের কিছু হত তা হলে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই থাকত না- কিন্তু, যেখানে নৈপুণ্য ও সৌষম্যের সীমা নেই, অতি সামান্য ভঙ্গিস্ট্রকুমাত্র যেখানে নিরর্থক নয়, বহু যত্ন ও বহু শক্তির দ্বারা যেখানে এই ললিতকলাটি একেবারে সুপরিণত হয়ে উঠেছে, সেখানে একে অবজ্ঞা করা চলে না । এই কথাই বলতে হয় যে, রূপের ও গতির ছন্দবোধ এদের মনে অত্যন্ত বেশি প্ৰবল ; সেই রূপের ও গতির ভাষা। এদের মনে যতখানি কথা কয় আমাদের মনে ততখানি কয় না | এদের গামেলান-সংগীতেও সেটা দেখতে পাই। প্রথমত যন্ত্রগুলি বহুসংখ্যক, বহু যত্নে সুশোভিত, এবং তাদের সমাবেশ সুসজ্জিত, যারা বাজাচ্ছে তাদের মধ্যে সংযত শোভনতা । এই রম্যদর্শন এদের কাছে অত্যাবশ্যক । চোখের দেখার সুখটুকু রক্ষা করে এদের যে সংগীতের আলোচনা সে হচ্ছে সুরের নাচ । ছন্দের লীলা। এদের কাছে গীতের ধারার চেয়ে বেশি। কিন্তু, ছন্দের লীলা আমাদের দেশের