পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি (? సా রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা রাজী । কবিকে জানাও, সোভিয়েট-সম্মিলনের বিচিত্র জাতির যৌতুম ||” দলের মধ্যে একজন ছিল তার মঙ্গোলীয় ছাদের মুখ । তার কথা জিজ্ঞাসা করতেই জবাব পেলুম, সে খিরগিজ-জাতীয় চাষীর ছেলে, মস্কেী এসেছে কলে কাপড় বোনার বিদ্যা শিখতে । তিন বছর বাদে এঞ্জিনিয়র হয়ে তাদের রিপাব্লিকে ফিরে যাবে।— বিপ্লবের পরে সেখানে একটা বড়ো কারখানা স্থাপিত হয়েছে, সেইখানে সে কাজ করবে । একটা কথা মনে রেখো, এরা নানা জাতির লোক কল-কারখানার রহস্য আয়ত্ত করবার জন্যে এত অবাধ উৎসাহ এবং সুযোগ পেয়েছে, তার একমাত্র কারণ যন্ত্রকে ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র স্বার্থসাধনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় না । যত লোকেই শিক্ষা করুক তাতে সকল লোকেরই উপকার, কেবল ধনীলোকের নয় । আমরা আমাদের লোভের জন্যে যন্ত্রকে দোষ দিই, মাতলামির জন্যে শাস্তি দিই তালগাছকে । মাস্টারমশায় যেমন নিজের অক্ষমতার জন্যে বেঞ্চির উপরে দাড় করিয়ে রাখেন ছাত্রকে । সেদিন মস্কেী কৃষি-আবাসে গিয়ে স্পষ্ট করে স্বচক্ষে দেখতে পেলুম, দশ বছরের মধ্যে রাশিয়ার চাষীরা ভারতবর্ষের চাষীদের কত বহুদূরে ছাড়িয়ে গেছে। কেবল বই পড়তে শেখে নি, ওদের মন গেছে বদলে, ওরা মানুষ হয়ে উঠেছে । শুধু শিক্ষার কথা বললে সব কথা বলা হল না, চাষের উন্নতির জন্যে সমস্ত দেশ জুড়ে যে প্রভূত উদ্যম সেও অসাধারণ । ভারতবর্ষেরই মতো এ দেশ কৃষিপ্রধান দেশ, এইজন্যে কৃষিবিদ্যাকে যতদূর সম্ভব এগিয়ে দিতে না পারলে দেশের মানুষকে বাচানো যায় না । এরা সে কথা ভোলে নি । এরা অতি দুঃসাধ্য সাধন করতে প্ৰবৃত্ত । সিভিল সার্ভিসের আমলাদের দিয়ে এরা মোটা মাইনেয়। আপিস চালাবার কাজ করছে না- যারা যোগ্য লোক, যারা বৈজ্ঞানিক, তারা সবাই লেগে গেছে । এই দশ বছরের মধ্যে এদের কৃষিচৰ্চাবিভাগের যে উন্নতি ঘটেছে তার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে জগতের বৈজ্ঞানিক-মহলে । যুদ্ধের পূর্বে এ দেশে বীজ-বাছাইয়ের কোনো চেষ্টাই ছিল না । আজ প্ৰায় তিন কোটি মণ বাছাই-করা বীজ এদের হাতে জমেছে । তা ছাড়া নূতন শস্যের প্রচলন শুধু এদের কৃষি-কলেজের প্রাঙ্গণে নয়, দ্রুতবেগে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে । কৃষি সম্বন্ধে বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাশালা আজারবাইজান উজবেকিস্তান জর্জিয়া যুক্রেন প্রভৃতি রাশিয়ার প্রত্যন্ত প্রদেশেও স্থাপিত হয়েছে। রাশিয়ার সমস্ত দেশ-প্ৰদেশকে জাতি-উপজাতিকে সক্ষম ও শিক্ষিত করে তোলবার জন্যে এতবড়ো সর্বব্যাপী অসামান্য অক্লান্ত উদ্যোগ আমাদের মতো ব্রিটিশ সাবজেক্টের সুদূর কল্পনার অতীত । এতটা দূর পর্যন্ত করে তোলা যে সম্ভব, এখানে আসবার আগে কখনো আমি তা মনেও করতে পারি নি। কেননা শিশুকাল থেকে আমরা যে “ল অ্যান্ড অর্ডার’এর আবহাওয়ায় মানুষ, সেখানে এর কাছে পৌছতে পারে এমন দৃষ্টান্ত দেখি নি । এবার ইংলন্ডে থাকতে একজন ইংরেজের কাছে প্রথম শুনেছিলুম সাধারণের কল্যাণের জন্যে এরা কিরকম অসাধারণ আয়ােজন করেছে। চােখে দেখলুম— এও দেখতে পেলুম, এদের রাষ্ট্রে জাতিবর্ণবিচার একটুও নেই। সোভিয়েট শাসনের অন্তর্গত বর্বরপ্রায় প্রজার মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্যে এরা যে প্রকৃষ্ট প্রণালীর ব্যবস্থা করেছে ভারতবর্ষের জনসাধারণের পক্ষে তা দুর্লভ | অথচ এ অশিক্ষার অনিবাৰ্য ফলে আমাদের বুদ্ধিতে চরিত্রে যে দুর্বলতা, ব্যবহারে যে মৃঢ়তা, দেশ-বিদেশের কাছে তার রটনা চলছে । ইংরেজিতেই কথা চলিত আছে, যে কুকুরকে ফাসি দিতে হবে তাকে বদনাম দিলে কাজ সহজ হয় । যাতে বদনামটা কোনোদিন না ঘোচে তার উপায় করলে যাবজজীবন মেয়াদ ও ফাসি দুই’ই মিলিয়ে নেওয়া চলে। ইতি ১ অক্টোবর ১৯৩০