পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি GS S) মনে রাখা চাই । রাজগৌরবের সঙ্গে প্রজাদের একটা মানবিক সম্বন্ধ থাকে, কিন্তু ধনলোভের সঙ্গে তা থাকতেই পারে না। ধন নির্মম, নৈর্ব্যক্তিক । যে মুরগি সোনার ডিম পাড়ে লোভ যে কেবল তার ডিমগুলোকেই বুড়িতে তোলে তা নয়, মুরগিটাকে সুদ্ধ সে জবাই করে । বণিকরাজের লোভ ভারতের ধন-উৎপাদনের বিচিত্র শক্তিকেই পঙ্গু করে দিয়েছে। বাকি রয়েছে কেবল কৃষি, নইলে কঁাচা মালের জোগান বন্ধ হয় এবং বিদেশী পণ্যের হাটে মূল্য দেবার শক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। ভারতবর্ষের সদ্যপাতী জীবিকা এই অতিক্ষীণ বুন্তের উপর নির্ভর করে আছে | এ কথা মেনে নেওয়া যাক, তখনকার কালে যে নৈপুণ্য ও যে-সকল উপায়ের যোগে হাতের কাজ চলত ও শিল্পীরা খেয়ে-পরে বঁাচত, যন্ত্রের প্রতিযোগিতায় তারা স্বতই নিক্রিয় হয়ে পড়েছে। অতএব প্রজাদের বঁাচাবার জন্যে নিতান্তই প্রয়োজন ছিল সর্বপ্রযত্নে তাদের যন্ত্রকুশল করে তোলা । প্ৰাণের দায়ে বর্তমান কালে সকল দেশেই এই উদ্যোগ প্রবল । জাপান অল্পকালের মধ্যে ধনের যন্ত্রবাহনকে আয়ত্ত করে নিয়েছে যদি না সম্ভব হত তা হলে যন্ত্রী যুরোপের ষড়যন্ত্রে সে ধনে-প্ৰাণে মারা যেত । আমাদের ভাগ্যে সে সুযোগ ঘটল না, কেননা লোভ ঈৰ্ষাপরায়ণ । এই প্ৰকাণ্ড লোভের আওতায় আমাদের ধনপ্রাণ মুষড়ে এল, তৎপরিবর্তে রাজা আমাদের সান্তনা দিয়ে বলছেন, “এখনো ধনপ্রাণের যেটুকু বাকি সেটুকু রক্ষা করবার জন্যে আইন এবং চৌকিদারের ব্যবস্থাভার রইল আমার হাতে ।” এ দিকে আমাদের অন্নবস্ত্ৰ বিদ্যাবুদ্ধি বন্ধক রেখে কণ্ঠাগত৷ প্ৰাণে আমরা চৌকিদারের উদির খরচ জোগাচ্ছি। এই-যে সাংঘাতিক ঔদাসীন্য এর মূলে আছে লোভ । সকলপ্রকার জ্ঞানে ও কর্মে যেখানে শক্তির উৎস বা পীঠস্থান সেখান থেকে বহু নীচে দাড়িয়ে এতকাল আমরা হা করে উপরের দিকে তাকিয়ে আছি আর সেই উধৰ্ব্বলোক থেকে এই আশ্বাসবাণী শুনে আসছি, “ তোমাদের শক্তি ক্ষয় যদি হয়। ভয় কী, আমাদের শক্তি আছে, আমরা তোমাদের রক্ষা করব ।” যার সঙ্গে মানুষের লোভের সম্বন্ধ তার কাছ থেকে মানুষ প্রয়োজন উদ্ধার করে, কিন্তু কখনো তাকে সম্মান করে না । যাকে সম্মান করে না তার দাবিকে মানুষ যথাসম্ভব ছোটাে করে রাখে ; অবশেষে সে এত সস্তা হয়ে পড়ে যে, তার অসামান্য অভাবেও সামান্য খরচ করতে গায়ে বাজে । আমাদের প্রাণরক্ষা ও মনুষ্যত্বের লজ্জােরক্ষার জন্যে কতই কম বরাদ্দ সে কারও অগোচর নেই। অন্ন নেই, বিদ্যা নেই, বৈদ্য নেই, পানের জল পাওয়া যায় পাক ছেকে ; কিন্তু চৌকিদারের অভাব নেই, আর আছে মোটা মাইনের কর্মচারী- তাদের মাইনে গালফ স্টমের মতো সম্পূৰ্ণ চলে যায় ব্রিটিশ দ্বীপের শৈত্যনিবারণের জন্যে, তাদের পেনসন জোগাই আমাদের অন্ত্যেষ্টিসৎকারের খরচের অংশ থেকে । এর একমাত্র কারণ, লোভ অন্ধ, লোভ নিষ্ঠুর- ভারতবর্ষ ভারতেশ্বরদের লোভের সামগ্ৰী । অথচ কঠিন বেদনার অবস্থাতেও এ কথা আমি কখনো অস্বীকার করি নে যে, ইংরেজের স্বভাবে ঔদার্য আছে, বিদেশীয় শাসনকার্যে অন্য য়ুরোপীয়দের ব্যবহার ইংরেজের চেয়েও কৃপণ এবং নিষ্ঠুর । ইংরেজ জাতি ও তার শাসননীতি সম্বন্ধে বাক্যে ও আচরণে আমরা যে বিরুদ্ধতা প্ৰকাশ করে থাকি তা আর-কোনো জাতের শাসনকর্তাদের সম্বন্ধে সম্ভবপর হত না ; যদি-বা হত। তবে তার দণ্ডনীতি আরো অনেক দুঃসহ হত, স্বয়ং য়ুরোপে এমন-কি, আমেরিকাতেও তার প্রমাণের অভাব নেই। প্রকাশ্যভাবে বিদ্রোহঘোষণাকালেও রাজপুরুষদের কাছে পীড়িত হলে আমরা যখন সবিস্ময়ে নালিশ করি তখন প্রমাণ হয় যে, ইংরেজ জাতির প্রতি আমাদের নিগুঢ় শ্রদ্ধা মার খেতে খেতেও মরতে চায় না। আমাদের স্বদেশী রাজা বা জমিদারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরো অনেক কম । ইংলন্ডে থাকার সময় এটা লক্ষ্য করে দেখেছি, ভারতবর্ষে দণ্ডবিধানব্যাপারে গ্রানিজনক ঘটনা ইংরেজ খবরের কাগজে প্ৰায় কিছুই এসে পৌঁছত না । তার একমাত্র কারণ এ নয়, পাছে য়ুরোপে বা আমেরিকায় নিন্দা রটে । বস্তুত, কড়া ইংরেজ শাসনকর্তা স্বজাতির শুভবুদ্ধিকেই ভয় করে । বেশ করেছি, খুব করেছি, দরকার ছিল জবরদস্তি করবার- এটা বুক ফুলিয়ে বলা ইংরেজদের পক্ষে সহজ নয়, তার কারণ ইংরেজের মধ্যে বড়ো মন আছে। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আসল কথাগুলো ইংরেজ খুব কম h