পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি - G? SSN সর্বসাধারণকে দীক্ষিত করে জাতি বর্ণ ও শ্রেণী -নির্বিশেষে সকলকেই মানুষ করে তোলবার একটা দুনিবার ইচ্ছা আছে। তা যদি না হত তা হলে ফরাসী পণ্ডিতের কথা মানতে হত যে, শিক্ষা দেওয়াটা একটা মস্ত ভুল । অর্থনৈতিক মতটা সম্পূর্ণ গ্রাহ্য কি না সে কথা বলবার সময় আজও আসে নি। কেননা এ মত এতদিন প্রধানত পুঁথির মধ্যেই টলৌ টলে বেড়াচ্ছিল, এমন বৃহৎ ক্ষেত্রে এতবড়ো সাহসের সঙ্গে ছাড়া পায় নি । যে প্রবল লোভের কাছে এই মত প্ৰথম থেকেই সাংঘাতিক বাধা পেত। সেই লোভকেই এরা সাংঘাতিকভাবে সরিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষার ভিতর দিয়ে পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এ মতের কতটুকু কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা আজ নিশ্চিত কেউ বলতে পারে না । কিন্তু এ কথাটা নিশ্চিত বলা যেতে পারে যে, রাশিয়ার জনসাধারণ এতকাল পরে যে শিক্ষা নির্বারিত ও প্রচুরভাবে পাচ্ছে তাতে করে তাদের মনুষ্যত্ব স্থায়ীভাবে উৎকর্ষ এবং সম্মানলাভ করল । বর্তমান রাশিয়ার নিষ্ঠুর শাসনের জনশ্রুতি সর্বদাই শোনা যায়— অসম্ভব না হতে পারে। নিষ্ঠুর শাসনের ধারা সেখানে চিরদিন চলে এসেছে, হঠাৎ তিরোভূত না হওয়াই সম্ভব । অথচ সেখানে চিত্ৰযোগে সিনেমাযোগে ইতিহাসের ব্যাখ্যায় সাবেক আমলের নিদারুণ শাসনবিধি ও অত্যাচারকে সোভিয়েট গর্বমেন্ট অবিরত প্রত্যক্ষ করিয়ে দিচ্ছে। এই গবমেন্ট নিজেও যদি এইরকম নিষ্ঠুর পথ অবলম্বন করে থাকে। তবে নিষ্ঠুরাচারের প্রতি এত প্ৰবল করে ঘূণা উৎপাদন করে দেওয়াটাকে, আর কিছু না হােক, অদ্ভুত ভুল বলতে হবে । সিরাজউদ্দৌলা-কর্তৃক কালা-গর্তের নৃশংসতাকে যদি সিনেমা প্রভৃতি দ্বারা সর্বত্র লাঞ্ছিত করা হত। তবে তার সঙ্গে সঙ্গেই জালিয়ানওআলাবাগের কাণ্ড করাটাকে অন্তত মুখতা বললে দোষ হত না । কারণ, এ ক্ষেত্রে বিমুখ অস্ত্ৰ অস্ত্রীকেই লাগবার কথা । সোভিয়েট রাশিয়ায় মার্কসীয় অর্থনীতি সম্বন্ধে সর্বসাধারণের বিচারবুদ্ধিকে এক ছাচে ঢালবার একটা প্রবল প্ৰয়াস সুপ্ৰত্যক্ষ ; সেই জেদের মুখে এ সম্বন্ধে স্বাধীন আলোচনার পথ জোর করে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এই অপবাদকে আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি । সেদিনকার যুরোপীয় যুদ্ধের সময় এইরকম মুখ চাপা দেওয়া এবং গবমেন্ট-নীতির বিরুদ্ধবাদীর মতস্বতন্ত্র্যকে জেলখানায় বা ফাসিকাঠে বিলুপ্ত করে দেওয়ার চেষ্টা দেখা গিয়েছিল । যেখানে আশু ফললাভের লোভ অতি প্রবল সেখানে রাষ্ট্রনায়কেরা মানুষের মতস্বাতন্ত্র্যের অধিকারকে মানতে চায় না । তারা বলে, ও-সব কথা পরে হবে, আপাতত কাজ উদ্ধার করে নিই । রাশিয়ার অবস্থা যুদ্ধকালের অবস্থা । অন্তরে বাহিরে শত্ৰু । ওখানকার সমস্ত পরীক্ষাকে পণ্ড করে দেবার জন্যে চারি দিকে নানা ছলবলের কাণ্ড চলছে । তাই ওদের নির্মাণকার্যের ভিতটা যত শীঘ পাকা করা চাই, এজন্যে বলপ্রয়োগ করতে ওদের কোনো দ্বিধা নেই । কিন্তু গরজ যত জরুরিই হােক, বল জিনিসটা একতরফা জিনিস। ওটাতে ভাঙে, সৃষ্টি করে না। সৃষ্টিকার্যে দুই পক্ষ আছে ; উপাদানকে স্বপক্ষে আনা চাই, মারধোর করে নয়, তার নিয়মকে স্বীকার করে । রাশিয়া যে কাজে লেগেছে। এ হচ্ছে যুগান্তরের পথ বানানো ; পুরাতন বিধিবিশ্বাসের শিকড়গুলো তার সাবেক জমি থেকে উপড়ে দেওয়া ; চিরাভ্যাসের আরামকে তিরস্কৃত করা । এরকম ভাঙনের উৎসাহে যে আবর্ত সৃষ্টি করে তার মাঝখানে পড়লে মানুষ তার মাতুনির আর অন্ত পায় না- স্পর্ধা বেড়ে ওঠে ; মানবপ্রকৃতিকে সাধনা করে বশ করবার অপেক্ষা আছে, এ কথা ভুলে যায় ; মনে করে, তাকে তার আশ্রয় থেকে ছিড়ে নিয়ে একটা সীতাহরণ-ব্যাপার করে তাকে পাওয়া যেতে পারে । তার পরে লঙ্কায় আগুন লাগে তো লাগুক | উপযুক্ত সময় নিয়ে স্বভাবের সঙ্গে রফা করবার তর সয় না। যাদের তারা উৎপাতকে বিশ্বাস করে ; অবশেষে লাঠিয়ে পিটিয়ে রাতারাতি যা গড়ে তোলে তার উপরে ভরসা রাখা চলে না, তার উপরে দীর্ঘকালের ভর সয় না । যেখানে মানুষ তৈরি নেই, মত তৈরি হয়েছে, সেখানকার উচ্চণ্ড দণ্ডনায়কদের আমি বিশ্বাস করি নে। প্রথম কারণ, নিজের মত সম্বন্ধে আগেভাগে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা সুবুদ্ধি নয়, সেটাকে কাজে খাটাতে খাটাতে তবে তার পরিচয় হয় । ও দিকে ধর্মতন্ত্রের বেলায় যে জননায়কেরা শাস্ত্ৰবাক্য মানে না