পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

We SR SR রবীন্দ্ৰ-বচনাবলী সেই দিকে তার তপস্যা শ্রেষ্ঠকে আবিষ্কার করে । সেই দিক আছে তার অস্তরে, যেখান থেকে চিরকালের সকলের চিন্তাকে সে চিন্তিত করে, সকলের ইচ্ছাকে সে সফল করে, রূপদান করে সকলের আনন্দকে । যে পরিমাণে তার গতি এর বিপরীত দিকে, বাহ্যিকতার দিকে, দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে, মানবসত্য থেকে সেই পরিমাণে সে ভ্ৰষ্ট ; সভ্যতার অভিমান সত্ত্বেও সেই পরিমাণে সে বর্বর । মানবদেহে বহুকোটি জীবকোষ ; তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জন্ম, স্বতন্ত্র মরণ । অণুবীক্ষণযোগে জানা যায়, তাদের প্রত্যেকের চারি দিকে ফঁােক । এক দিকে এই জীবকোষগুলি আপনি আপন পৃথক জীবনে জীবিত, আর-এক দিকে তাদের মধ্যে একটি গভীর নির্দেশ আছে, প্রেরণা আছে, একটি ঐক্যতত্ত্ব আছে, সেটি অগোচর পদার্থ ; সেই প্রেরণা সমগ্র দেহের দিকে, সেই ঐক্য সমস্ত দেহে ব্যাপ্ত । মনে করা যেতে পারে, সেই সমগ্র দেহের উপলব্ধি অসংখ্য জীবকোষের অগম্য, অথচ সেই দেহের পরম রহস্যময় আহবান তাদের প্রত্যেকের কাছে দাবি করছে তাদের আত্মনিবেদন । যেখানে তারা প্ৰত্যেকে নিজেরই স্বতন্ত্র জীবনসীমায় বর্তমান সেখানে তার মধ্যে রহস্য কিছুই নেই । কিন্তু, যেখানে তারা নিজের জীবনসীমাকে অতিক্রম করে সমস্ত দেহের জীবনে সত্য সেখানে তারা আশ্চৰ্য্য, সেখানে তারা আপন স্বতন্ত্র জন্মমৃত্যুর মধ্যে বদ্ধ নয় । সেইখানে তাদের সার্থকতা । শোনা যায়, প্রতি সাত বছর অন্তর মানুষের দেহে এই জীবকোষগুলির পরিবর্তন ঘটে । তারা বিদায় নেয়, অর্থাৎ তাদের পৃথক সত্তা থাকে না । কিন্তু তাদের মধ্যে যে সত্তা সমস্ত দেহের আয়ুর অন্তর্গত, অর্থাৎ যেটা তাদের স্বদৈহিক নয়, বিশ্বদৈহিক, সেই সত্তা সমস্ত দেহের জীবনপ্রবাহে থেকে যায় } দেহে কখনো কখনো কর্কটরোগ অর্থাৎ ক্যান্সার জন্মায় ; সেই ক্যান্সার একান্তই স্বতন্ত্র, বলা যেতে পারে তার মধ্যে দেহাত্মবোধ নেই । সমগ্র দেহের সে প্রতিকৃলি । দেহের পক্ষে একেই বলা যায় অশুত । মানুষের দেহের জীবকোষগুলির যদি আত্মবোধ থাকত তা হলে এক দিকে তারা ক্ষুদ্রভাবে আপনাদেরকে স্বতন্ত্র জানত, আবার বৃহৎভাবে নিজেদেরকে জানত সমগ্র দেহে ! কিন্তু জানত অনুভবে, কল্পনায় ; সমগ্ৰ দেহকে প্ৰত্যক্ষত ও সম্পূর্ণত জানা সম্ভব হত না । কেননা এই দেহ শুধু যে বর্তমানে অধিষ্ঠিত তা নয়, এই দেহে রয়েছে তার অতীত, অপেক্ষা করছে তার ভবিষ্যৎ । আরো একটা প্ৰত্যক্ষাতীত পদার্থ রয়েছে যা সর্বদেহব্যাপী কল্যাণ, যাকে বলি স্বাস্থ্য, যাকে বিশ্লেষণ করা যায় না । তা ছাড়াও সমগ্র জীবনরক্ষার গভীরতর চেষ্টা প্ৰত্যেক জীবকোষের আছে, যে চেষ্টা রোগের অবস্থায় সর্বদেহের শক্রহননে নিজেদের আত্মহানিও ঘটায়, দেশপ্রেমিক যেমন করে দেশের জন্যে প্ৰাণ দেয় । এই চেষ্টার রহস্য অনুসরণ করলেই বোঝা যেতে পারে, এই ক্ষুদ্র দেহগুলির চরম লক্ষ্য অর্থাৎ পরম ধর্ম এমন-কিছুকে আশ্রয় করে যাকে বলব তাদের বিশ্বদেহ । মানুষও আপন অন্তরের গভীরতর চেষ্টার প্রতি লক্ষ করে অনুভব করেছে যে, সে শুধু ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বাগত মানুষের একাত্ম । সেই বিরাট মানব “অবিভক্তঞ্চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ। স্থিতম | সেই বিশ্বমানবের প্রেরণায় ব্যক্তিগত মানুষ এমন-সকল কাজে প্রবৃত্ত হয় যা তার ভৌতিক সীমা অতিক্রমণের মুখে । যাকে সে বলে ভালো, বলে সুন্দর, বলে শ্রেষ্ঠ— কেবল সমাজবাক্ষার দিক থেকে নয়— আপন আত্মার পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তির দিক থেকে । ডিমের ভিতরে যে পাখির ছানা আছে তার অঙ্গে দেখতে পাই ডানার সূচনা । ডিমে-বাধা জীবনে সেই ডানার কোনো অর্থই নেই । সেখানে আছে ডানার অবিচলিত প্ৰতিবাদ । এই অপরিণত ডানার সংকেত জানিয়ে দেয়, ডিমের বাইরে সত্যের যে পূর্ণতা আজও তার কাছে অপ্রত্যক্ষ সেই মুক্ত সত্যে সঞ্চারণেই পাখির সার্থকতা । তেমনিই মানুষের চিত্তবৃত্তির যে ঔৎসুক্য মানুষের পূর্ণ সত্যের সাক্ষ্য দেয় সেইখানেই অনুভব করি তার ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য থেকে মুক্তি । সেইখানে সে বিশ্বাভিমুখী । জীবকে কল্পনা করা যাক, সে যেন জীবনযাত্রার একটা রেলগাড়ির মধ্যেই জন্মায়, বেঁচে থাকে এবং মরে । এই গাড়ি সংকীর্ণ লক্ষ্যপথে বাধা রাস্তায় চলে । জন্তুর মাথাটা গাড়ির নিম্নতলের সমরেখায় ।