পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম Vb RS) সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ বলে, তদবিদ্ধি নেদং যদিদম উপাসতে । তাকেই জানো । কাকে না, ইদং অর্থাৎ এই-যে বলে যাকে স্বীকার করি তাকে নয়। ‘এই-যে আমি শুনছি' এ হল সহজ কথা । তবুও মানুষ বললে, এর শেষ কথা সেইখানে যেখানে ইদং সর্বনাম পৌছয় না । খোপার মতো সে জিজ্ঞাসা করে কোথায় আছে শ্রোত্ৰস্য শ্রোত্ৰং- শ্রবণেরও শ্রবণ | ভৌতিক প্ৰণালীতে খোজ করতে করতে এসে ঠেকে বাতাসের কম্পনে । কিন্তু, ওখানেও রয়েছে ইন্দং, “এই-যে কম্পন’ । কম্পন তো শোনা নয় । যে বলছে “আমি শুনছি।’ তার কাছে পৌছনো গেল । তারও সত্য কোথায় । উপর থেকে নীচে পড়ল একটা পাথর । জ্ঞানের দেউড়িতে যে দ্বারী থাকে সে খবর দিলে, এই-যে পড়েছে । নীচের দিকে উপরের বস্তুর যে টান সেইটে ঘটল । দ্বারীর কর্তব্য শেষ হল । ভিতর-মহল থেকে শোনা গেল, একে টান, ওকে টান, তাকে টান, বারে বারে “এই-যে’ । কিন্তু সব “এই-যোঁকে পেরিয়ে বিশ্বজোড়া একমাত্র টান । উপনিষদ সকলের মধ্যে এই এককে জানাই বলেন প্রতিবোধবিদিতম- প্ৰত্যেক পৃথক পড়ার বোধে একটি অদ্বিতীয় টানকে সত্য বলে জানা । তেমনি, আমি শুনি, তুমি শোন, এখন শুনি, তখন শুনি, এই প্রত্যেক শোনার বোধে যে একমাত্র পরম শোনার সত্য বিদিত সেই প্রতিবোধবিদিত এক সত্যই শ্রোত্ৰস্য শ্রোত্ৰং । তার সম্বন্ধে উপনিষদ বলেন, অন্যদেব তদবিদিতাদথো অবিদিতাবধি । আমরা যা-কিছু জানি এবং জানি নে সব হতেই স্বতন্ত্র । ভৌতিক বিজ্ঞানেও যা গুহাহিত তাকে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে কেবল যে মেলাতে পারি। নে তা নয়, বলতে হয়- এ তার বিপরীত । ভাষায় বলি ভারাকর্ষণশক্তি, কিন্তু আকর্ষণ বলতে সাধারণত যা বুঝি। এ তা নয়, শক্তি বলতে যা বুঝি। এ তাও নয় । প্ৰকৃতির গুহাহিত শক্তিকে আবিষ্কার ও ব্যবহার করেই মানুষের বাহিরের সমৃদ্ধি ; যে সত্যে তার আত্মার সমৃদ্ধি সেও গুহাহিত, তাকে সাধনা করেই পেতে হবে । সেই সাধনাকে মানুষ বলে ধর্মসাধনা | ধর্ম শব্দের অর্থ স্বভাব । চেষ্টা করে সাধনা করে স্বভাবকে পাওয়া, কথাটা শোনায় স্ববিরোধী অর্থাৎ স্বভাবকে অতিক্রম করে স্বভাবকে পাওয়া । খৃস্টানশাস্ত্ৰে মানুষের স্বভাবকে নিন্দা করেছে ; বলেছে, তার আদিতেই পাপ, অবাধ্যতা । ভারতীয় শাস্ত্রেও আপনার সত্য পাবার জন্যে স্বভাবকে অস্বীকার করতে বলে । মানুষ নিজে সহজে যা তাকে শ্রদ্ধা করে না । মানুষ বলে বসিল, তার সহজ স্বভাবের চেয়ে তার সাধনার স্বভাব সত্য । একটা স্বভাব তার নিজেকে নিয়ে, আর-একটা স্বভাব তার ভূমাকে নিয়ে । কথিত আছে- - শ্ৰেয়শ্চ প্ৰেয়শ্চ মনুষ্যমেতসতীে সম্পরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ । তয়োঃ শ্রেয় আদদানস্য সাধু হীয়তেহর্থাদ যা উ প্রেয়োবৃণীতে । মানুষের স্বভাবে শ্রেয়ও আছে, প্রেয়ও আছে। ধীর ব্যক্তি দুইকে পৃথক করেন । যিনি শ্রেয়কে গ্রহণ করেন তিনি সাধু, যিনি প্রেয়কে গ্রহণ করেন। তিনি পুরুষাৰ্থ থেকে হীন হন । এ-সব কথাকে আমরা চিরাভ্যন্ত হিতকথা বলে গণ্য করি। অর্থাৎ মনে করি, লোকব্যবহারের উপদেশরূপেই এর মূল্য । কিন্তু, সমাজব্যবহারের প্রতি লক্ষ করেই এ শ্লোকটি বলা হয় নি । এই শ্ৰোকে আত্মাকে সত্য করে জানিবার উপায় আলোচনা করা হয়েছে । প্ৰবৃত্তির প্রেরণায় আমরা যা ইচ্ছা করি সেই প্ৰেয়ের ইচ্ছা মানুষের স্বভাবে বর্তমান, আবার যা ইচ্ছা! করা উচিত সেই শ্রেয়ের ইচ্ছাও মানুষের স্বভাবে । শ্রেয়কে গ্রহণ করার দ্বারা মানুষ কিছু-একটা পায় যে তা নয়, কিছু-একটা হয় । সেই হওয়াকে বলে সাধু হওয়া । তার দ্বারা ধনী হয় না, বলী হয় না, ‘সমাজে সম্মানিত হতেও পারে, না-হতেও পারে, এমন-কি, অবমানিত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট । সাধু হওয়া পদার্থটা কী, প্ৰকৃতির রাজ্যে তার কোনো কিনারা নেই । শ্ৰেয় শব্দটাও তেমনি । অপর পক্ষে প্রোয়কে একান্তরাপে বরণ করার দ্বারা মানুষ আর-একটা কিছু হয়, তাকে উপনিষদ বলছেন- আপনি