পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম So SS সাতার কাটছে ঘন্টার পর ঘণ্টা, বাইসিকলে অবিশ্রাম ঘুরপাক খাচ্ছে, দীর্ঘ উপবাস করছে স্পর্ধা করে, কেবলমাত্র অস্বাভাবিকতার গৌরব প্রচারের জন্যে । ময়ূরকে দেখা যায় গর্ব করতে আপন ময়ূরত্ব নিয়েই, হিংস্ৰ জন্তু উৎসাহ বােধ করে আপনার হিংস্রতার সাফল্যে । কিন্তু, বর্বর মানুষ মুখশ্ৰীীর বিকৃতি ও বেশভূষার অতিকৃতি নিয়ে গর্ব করে জানায়, “আমি ঠিক মানুষের মতো নাই, সাধারণ মানুষরূপে আমাকে চেনবার জো নেই ।” এমনতরো আত্মপ্রকাশের চেষ্টাকে বলি নাঙর্থক, এ সদর্থক নয় ; প্ৰকৃতির বিরুদ্ধে স্পর্ধামাত্র, যা তার সহজ তার প্রতিবাদমাত্ৰ- তার বেশি আর কোনো অর্থ এতে নেই । অহংকারের প্রকাশকে আত্মগৌরবের প্রকাশ বলে মনে করা বর্বরতা, যেমন নিরর্থক বাহ্যানুষ্ঠানকে মনে করা পুণানুষ্ঠান । এ যেমন দৈহিক দিকে তেমনি আর্থিক দিকেও মানুষের স্পর্ধার অস্ত নেই। এখানেও রেকর্ড ব্রেক করা পৰ্ব্ব-ইতিহাসের বেডা-ডিঙোনো লম্বফ । এখানকার চেষ্টা ঠিক অস্বাভাবিকের জন্যে নয়, অসাধারণের জন্যে । এতে আছে সীমার প্রতি অসহিষ্ণুতা তার বাইরে আর কিছুই নয় । কিন্তু, যা-কিছু বস্তুগত যা বাহ্যিক, সীমাই তার ধর্ম । সেই সীমাকে বাড়িয়ে চলা যায়, পেরিয়ে যাওয়া যায় না । যিশুখস্ট বলেছেন, সূচীর রন্ধ দিয়ে উট যেমন গলে না। ধনীর পক্ষে স্বৰ্গদ্বার তেমনি দুৰ্গম । কেননা ধনী নিজের সত্যকে এমন-কিছুর দ্বারা অনুভব ও প্রকাশ করতে অভ্যস্ত যা অপরিমেয়ের বিপরীত, . তাই সে স্ট্রীয়তেহর্থাৎ, মনুষ্যত্বের অর্থ হতে হীন হয় । হাতির মতো বড়ো হওয়াকে মানুষ বড়োলোক হওয়া বলে না, হয়তো বর্বর মানুষ তাও বলে । বাহিরের উপকরণ পুঞ্জিত করার গর্ব করা সম্বন্ধেও সেই কথা খাটে । অন্যের চেয়ে আমার বস্তুসঞ্চয় বেশি, এ কথা মানুষের পক্ষে বলবার কথা নয় । তাই মৈত্ৰেয়া বলেছিলেন, যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন। কুৰ্য্যাম । তিনি উপেক্ষা করেছিলেন উপকরণবতাং জীবিতম | যে ওস্তাদ তানের অজস্রতা গণনা করে গানের শ্রেষ্ঠতা বিচার করে তার বিদ্যাকে সেই উটেব সঙ্গে তুলনা করব । শ্রেষ্ঠ গান এমন পর্যাপ্তিতে এসে স্তব্ধ হয় যার উপরে আর একটিমাত্র সুরও যোগ করা যায় না । বস্তুত গানের সেই থামাকে সীমা বলা যায় না । সে এমন একটি শেষ যার শেষ নেই । অতএব যথার্থ গায়কের আত্মা আপন সার্থকতাকে প্রকাশ করে তানের প্রভূত সংখ্যার দ্বারা নয়, সমগ্র গানের সেই চরম রূপের দ্বারা, যা অপরিমেয়, অনির্বচনীয়, বাইরের দৃষ্টিতে যা স্বল্প, অস্তরে যা আসাম । তাই মানুষের যে সংসার তার অহং-এর ক্ষেত্র সে দিকে তার অহংকার ভূবিতায়, যে দিকে তার আত্মা সে দিকে তার সার্থকতা ভূমায় । এক দিকে তার গর্ব স্বার্থসিদ্ধিতে, আর-এক দিকে তার গৌরব পরিপূর্ণতায় । সৌন্দর্য কল্যাণ বীৰ্য ত্যাগ প্ৰকাশ করে মানুষের আত্মাকে, অতিক্রম করে প্রাকৃত মানুষকে, উপলব্ধি করে জীবমানবের অন্তরতম বিশ্বমানবকে । যং লব্ধা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ । চারি দিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্য-সকল প্ৰাণী, বাইরে থেকে জীবিকার অর্থ খুঁজে খুঁজে । মানুষ আপন অস্তরের মধ্যে আশ্চর্য হয়ে কাকে অনুভব করলে । যিনি নিহিতার্থে দধাতি, যিনি তাকে তার অন্তনিহিত অর্থ দিচ্ছেন । সেই অর্থ মানুষের আপনি আত্মারই গভীর অর্থ । সেই অর্থ এই যে মানুষ মহৎ । মানুষকে প্রমাণ করতে হবে যে, সে মহৎ ; তবেই প্ৰমাণ হবে যে, সে মানুষ । প্ৰাণের মূল্য দিয়েও তার আপনি ভূমাকে প্ৰকাশ করতে হবে ; কেননা তিনি চিরন্তন মানব, সর্বজনীন মানব, তিনি মৃত্যুর অতীত— তাকে যে অর্ঘ্য দিতে হবে সে অর্ঘ্য সকল মানুষের হয়ে, সকল কালের হয়ে, আপনারই অন্তরতম বেদীতে । আপনারই পরামকে না দেখে মানুষ বাইরের দিকে সার্থকতা খুঁজে বেড়ায় । শেষকালে উদভ্ৰান্ত হয়ে ক্লান্ত হয়ে সে বলে, কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম । মানুষের দেবতা মানুষের মনের মানুষ ; জ্ঞানে কর্মে ভাবে যে পরিমাণে সত্য হই সেই পরিমাণেই সেই মনের মানুষকে পাই— অস্তরে বিকার ঘটলে সেই আমার আপন মনের মানুষকে মনের মধ্যে দেখতে পাই নে । মানুষের যত-কিছু দুৰ্গতি আছে সেই আপন মনের মানুষকে হারিয়ে, তাকে বাইরের উপকরণে খুঁজতে গিয়ে, অর্থাৎ আপনাকেই পর করে দিয়ে । আপনাকে তখন টাকায় দেখি, খ্যাতিতে দেখি, ভোগের আয়ােজনে দেখি । এই নিয়েই তো মানুষের যত বিবাদ, যত কান্না। সেই বাইরে-বিক্ষিপ্ত আপনাহারা