পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম \3G Q কাল গান ফুরাইবে, তা বলে গাবে না কেন, আজ যাবে হয়েছে প্ৰভাত । -- শুধাই তোদের, তোরা বল ! আনন্দ-মাঝারে সব উঠিতেছে ভেসে ভেসে, আনন্দে হতেছে কীভূ লীন, চাহিয়া ধরণী—পানে নব আনন্দের গানে মনে পডে আর-এক দিন । এই-যে বিরাট আনন্দের মধ্যে সব তরঙ্গিত হচ্ছে তা দেখি নি বহুদিন, সেদিন দেখলুম। মানুষের বিচিত্র সম্বন্ধের মধ্যে একটি আনন্দের রস আছে । সকলের মধ্যে এই-যে আনন্দের রস, তাকে নিয়ে মহারাসের প্রকাশ । রসো বৈ সঃ । রসের খণ্ড খণ্ড প্ৰকাশের মধ্যে তাকে পাওয়া গিয়েছিল । সেই অনুভূতিকে প্রকাশের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলুম, কিন্তু ভালোরকম প্রকাশ করতে পারি নি। যা বলেছি অসম্পূর্ণভাবে বলেছি। প্রভাতসংগীতের শেষের কবিতা আজ আমি কথা কহিব না । আর আমি গান গাহিব না । হেরো আজি ভোরবেলা এসেছে রে মেলা লোক, চেয়ে আছে অনিমিখে, হেরে মোর হাসিমুখ ভুলে গেছে দু:খশোক । আজ আমি গান গাহিব না । এর থেকে বুঝতে পারা যাবে, মন তখন কী ভাবে আবিষ্ট হয়েছিল, কোন সত্যকে মন স্পর্শ করেছিল । যা-কিছু হচ্ছে সেই মহামানবে মিলছে, আবার ফিরেও আসছে সেখান থেকে প্ৰতিধ্বনিরূপে নানা রসে সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয়ে । এটা উপলব্ধি হয়েছিল অনুভূতিরূপে, তত্ত্বরূপে নয় । সে সময় বালকের মন এই অনুভূতি-দ্বারা যেভাবে আন্দোলিত হয়েছিল তারই অসম্পূৰ্ণ প্ৰকাশ প্রভাতসংগীতের মধ্যে । সেদিন অকসফোর্ডে যা বলেছি তা চিন্তা করে বলা । অনুভূতি থেকে উদ্ধার করে অন্য তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে যুক্তির উপর খাড়া করে সেটা বলা । কিন্তু, তার আরম্ভ ছিল এখানে । তখন স্পষ্ট দেখেছি, জগতের তুচ্ছতার আবরণ খসে গিয়ে সত্য অপরূপ সৌন্দর্যে দেখা দিয়েছে । তার মধ্যে তর্কের কিছু নেই, সেই দেখাকে তখন সত্যরূপে জেনেছি। এখনো বাসনা আছে, হয়তো সমস্ত বিশ্বের আনন্দরূপকে কোনো—এক শুভমুহুর্তে আবার তেমনি পরিপূর্ণভাবে কখনো দেখতে পাব । এইটে যে একদিন বাল্যাবস্থায় সুস্পষ্ট দেখেছিলুম, সেইজন্যেই “আনন্দরূপমমৃতং যদবিভাতি’ উপনিষদের এই বাণী আমার মুখে বার বার ধ্বনিত হয়েছে । সেদিন দেখেছিলুম, বিশ্ব স্কুল নয়, বিশ্বে এমন কোনো বস্তু নেই যার মধ্যে রসস্পর্শ নেই। যা প্রত্যক্ষ দেখেছি তা নিয়ে তর্ক কেন । স্কুল আবরণের মৃত্যু আছে, অন্তরতম আনন্দময় যে সত্তা তার মৃত্যু নেই। VO বর্ষার সময় খালটা থাকত জলে পূর্ণ। শুকনোর দিনে লোক চলত। তার উপর দিয়ে । এ পারে ছিল একটা হাট, সেখানে বিচিত্ৰ জনতা । দোতলার ঘর থেকে লোকালয়ের লীলা দেখতে ভালো লগত । পদ্মায় আমার জীবনযাত্রা ছিল জনতা থেকে দূরে । নদীর চর, ধু-ধু বালি, স্থানে স্থানে জলকুণ্ড ঘিরে।