পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় _ ৬৩৭ হীরেন্দ্রনাথ দত্ত (সভাপতি ) যোগদান করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উক্ত আলোচনাপ্রসঙ্গে বলেন : পণ্ডিত সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ মহাশয় যে-সকল কথার উল্লেখ করিয়াছেন, তজ্জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি। বাংলাভাষার আকৃতি কিরূপ হইলে ভালো হয়, সে সম্বন্ধে আমার মত যে কী, তাহা আমি এ প্রবন্ধে বলি নাই, বলিতে আসিও নাই। ংস্কৃতভাষার সাহায্য ভিন্ন বাংলাভাষা যে সুসংগতভাবে প্রকাশ করা যায়, তাহ। বিশ্বাস করি না। আমার এ প্রবন্ধ ব্যাকরণমূলক। চলিত কথাগুলির মধ্যে ব্যাকরণের যে-একটি সূক্ষ্ম সুত্র বর্তমান আছে, আমি তাহাই টানিয়া বাহির করিয়া আপনাদের দেখাইতেছি। আপনারা দেখুন, আমি যাহা বাহির করিয়াছি তাহ ঠিক কি না, তাহ টেকে কি না। কেহ যেন মনে না করেন, আমি এই-সকল শব্দ অবাধে যেখানে-সেখানে সাহিত্যে ব্যবহার করিতে চাই। আমি সে-পক্ষে বিধান দিবার চেষ্টা করি নাই। ভাষায় যাহা আছে, আমি তাহাই ব্যাখ্যা করিতে প্রয়াস পাইয়াছি। লিখিত ভাষায় এ-সকল শব্দ চলিবে কি না তাহ বিচার্য। আবশ্বক ৩ প্রবন্ধপাঠকের সহিত আমার একটা বিশেষ মতভেদ আছে । তিনি বলেন, এই সকল বিষয় অকিঞ্চিৎকর ও বিস্মরণযোগ্য, আমি তাহ কিছুতেই স্বীকার করি না। অন্ত কোনো বিষয়ে আমার সহিত র্তাহার কোনো মতভেদ নাই। র্তাহার প্রবন্ধ রচনানির্দেশের নিয়মপ্রকাশক নহে। বিদ্যাভূষণ মহাশয় আশঙ্কিত হইয়াছেন কেন বলিতে পারি না। সংস্কৃত ছাড়িয়া বাংলাভাষা চলে না, কিন্তু তাই বলিয়া সংস্কৃতের অনাবশ্বক প্রলেপ দিয়া বাংলাকে ভারাক্রান্ত করিবার আবগুক কী। রবীন্দ্রবাবু যেসকল শব্দ সম্বন্ধে আজ নানাবিধ তথ্য প্রকাশ করিলেন, বিদ্যাভূষণ মহাশয় তাহাদিগকে ভঙ্গুর বলিতেছেন কেন । কতকগুলি শব্দ কেন, সমস্ত ভাষাই তো ভঙ্গুর। সংস্কৃতসাহিত্যের বৈদিক শব্দই আর এখন কি ব্যবহার হয়, না সে ভাষা চলে ? সেক্সপিয়রের ভাষা, ড্রাইডেনের ভাষা এখনকার ইংরেজিসাহিত্যে অপ্রচলিত হইয়৷ গিয়াছে। সেক্সপিয়র অপেক্ষ ড্রাইডেন আধুনিক। র্তাহার শব্দগুলা পর্যন্ত অব্যবহার্য হইয়া যাইতেছে । যোগ্যতমের উদ্ববর্তন ভাষাতত্ত্বেও খাটে। রবীন্দ্রবাবু এই-সকল শব্দকে চিরস্থায়ী করিতে চেষ্টা পান নাই । শব্দকে স্থায়ী করিতে কেহ পারে না। মহাকবি-প্রয়োগ কতকটা হয়, সম্পূর্ণ হয় না। সেক্সপিয়র তাহার উদাহরণ। বিভক্তিও ভাষার ইঙ্গিত। ইংরেজিতে বিভক্তির preposition পূর্বনিপাত এবং বাংলায় পরনিপাত (post-position ) হয়। যেমন to me' ও গাছ থেকে । রবীন্দ্রবাবু কবির দৃষ্টিতে মাতৃভক্তের ভক্তিতে এই সকল আবিষ্কার করিয়াছেন। খুটখাট্‌ শব্দ মুটুনাই হইয় গেলে আত্মার দেহান্তর গ্রহণবং হয়। রবীন্দ্রবাবু আমাদের চিরপরিচিত শব্দগুলিকে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে দেখিয়াছেন এবং > দেখাইয়াছেন । এই-সকল শব্দের ভাষায় বহুল ব্যবহার হইবে কি না তাহা আর এখন জিজ্ঞাস্ত হইতে পারে না। নাটকে এই সকল শব্দ গৃহীত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। স্বরচিত নাটক ভাষায় বহুকাল থাকিবে। বৈজ্ঞানিকের চক্ষে কিছুই নগণ্য হইতে পারে না । সেইরূপ ভাষাতত্ত্ববিদের নিকট কোনো শব্দই উপেক্ষিত হইবার নহে। ব্যাকরণ আইননিগড় নয়। ভাষার স্বরূপ, ভাষার ইঙ্গিত, বিভক্তি প্রভৃতিকে ব্যাকরণ বৈজ্ঞানিক ভাবে দেখাইয় দেয়। সিংহ বর্ণনায় কেশর বাদ দেওয়া যাহা, লাঙ্গুল বাদ দেওয়া তাহ। ধ্বস্তাত্মক শব্দ বাদ দিলে ভাষাতত্ত্বালোচকের দৃষ্ট ভ্রান্ত হইবে। —হীরেন্দ্রনাথ দত্ত।