পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

set. «9oዒ হালদারগোষ্ঠীর । একদিন ছিল, যখন নীলকণ্ঠের ফরমাশে-গড়া গহনা তাহার এই হৃদয়বিহারিণী কিরণের গায়ে ঠিকমত মানাইত না বলিয়া বনোয়ারি খুঁতখুঁত করিত। আজ দেখিল, কালিদাস হইতে আরম্ভ করিয়া অমরু ও চেীর কবির যে-সমস্ত কবিতার সোহাগে সে প্ৰেয়সীকে মণ্ডিত করিয়া আসিয়াছে আজ তাহা এই হালদারগোষ্ঠীর বড়োবউকে কিছুতেই মানাইতেছে না । হায় রে, বসন্তের হাওয়া। তবু বহে, রাত্রে শ্রাবণের বর্ষণ তবু মুখরিত হইয়া উঠে এবং অতৃপ্ত প্রেমের বেদনা শূন্য হৃদয়ের পথে পথে কাদিয়া কাদিয়া বেড়ায় । প্রেমের নিবিড়তায় সকলের তো প্রয়োজন নাই ; সংসারের ছোটাে কুনকের মাপের বাধা বরাদে অধিকাংশ লোকের বেশ চলিয়া যায়। সেই পরিমিত ব্যবস্থায় বৃহৎ সংসারে কোনো উৎপাত ঘটে না । কিন্তু, এক-একজনের ইহাতে কুলায় না । তাহারা অজাত পক্ষীশাবকের মতো কেবলমাত্র ডিমের ভিতরকার সংকীর্ণ খাদ্যরসাটুকু লইয়া বঁাচে না, তাহারা ডিম ভাঙিয়া বাহির হইয়াছে, নিজের শক্তিতে খাদ্য আহরণের বৃহৎ ক্ষেত্র তাহাদের চাই । বনোয়ারি সেই ক্ষুধা লইয়া জন্মিয়াছে, নিজের প্ৰেমকে নিজের পৌরুষের দ্বারা সার্থক করিবার জন্য তাহার চিত্ত উৎসুক, কিন্তু যেদিকেই সে ছুটিতে চায় সেইদিকেই হালদারগোষ্ঠীর পাকা ভিত ; নড়িতে গেলেই তাহার মাথা ঠকিয়া যায় । দিন আবার পূর্বের মতো কাটিতে লাগিল । আগের চেয়ে বনোয়ারি শিকারে বেশি মন দিয়াছে, ইহা ছাড়া বাহিরের দিক হইতে তাহার জীবনে আর বিশেষ কিছু পরিবর্তন দেখা গেল না । অন্তঃপুরে সে আহার করিতে যায়, আহারের পর স্ত্রীর সঙ্গে যথা পরিমাণে বাক্যালাপও হয় । মধুকৈবর্তকে কিরণ আজও ক্ষমা করে নাই, কেননা, এই পরিবারে তাহার স্বামী যে আপন প্রতিষ্ঠা হারাইয়াছে তাহার মূল কারণ মধু । এইজন্য ক্ষণে ক্ষণে কেমন করিয়া সেই মধুর কথা অত্যন্ত তীব্ৰ হইয়া কিরণের মুখে আসিয়া পড়ে । মধুর যে হাড়ে হাড়ে বজাতি, সে যে শয়তানের অগ্রগণ্য, এবং মধুকে দয়া করাটা যে নিতান্তই একটা ঠিকা, এ কথা বার বার বিস্তারিত করিয়াও কিছুতে তাহার শান্তি হয় না । বনোয়ারি প্রথম দুই-একদিন প্রতিবাদের চেষ্টা করিয়া কিরণের উত্তেজনা প্ৰবল করিয়া তুলিয়াছিল, তাহার পর হইতে সে কিছুমাত্র প্রতিবাদ করে না। এমনি করিয়া বনোয়ারি তাহার নিয়মিত গহধর্ম রক্ষা করিতেছে ; কিরণ ইহাতে কোনো অভাব-অসম্পূর্ণতা অনুভব করে না,কিন্তু ভিতরে ভিতরে বনোয়ারির জীবনটা বিবৰ্ণ, বিরস এবং চির-অভুক্ত । এমন সময় জানা গেল বাড়ির ছোটােবাউ, বংশীর স্ত্রী গর্ভিণী । সমস্ত পরিবার আশায় উৎফুল্প হইয়া উঠিল। কিরণের দ্বারা এই মহাদ্যবংশের প্রতি যে কর্তব্যের ত্রুটি হইয়াছিল, এতদিন পরে তাহা পূরণের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে ; এখন ষষ্ঠীর কৃপায় কন্যা না হইয়া পুত্ৰ হইলে রক্ষা । পুত্ৰই জন্মিল । ছোটােবাবু কলেজের পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ বংশের পরীক্ষাতেও প্রথম মার্ক পাইল । তাহার আদর উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠিতেছিল, এখন তাহার আদরের সীমা রহিল না । সকলে মিলিয়া এই ছেলেটিকে লইয়া পড়িল । কিরণ তো তাহাকে এক মুহুর্ত কোল হইতে নামাইতে চায় না । তাহার এমন অবস্থা যে, মধুকৈবর্তের স্বভাবের কুটিলতার কথাও সে প্রায় বিস্মৃতি হইবার জো হইল । তাহার গভীর স্নেহ এবং করুণা। সকল মানুষেরই প্রকৃতির মধ্যে বিধাতা এমন একটা-কিছু দেন যাহা তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ; নিহিলে বনোয়ারি যে কেমন করিয়া পাখি শিকার করিতে পারে বোঝা যায় না । কিরণের কোলে একটি শিশুর উদয় দেখিবে, এই ইচ্ছা বনোয়ারির মনে বহুকাল হইতে অতৃপ্ত হইয়া আছে। এইজন্য বংশীর ছেলে হইলে প্রথমটা তাহার মনে একটু ঈর্ষার বেদনা জন্মিয়াছিল, কিন্তু সেটাকে দূর করিয়া দিতে তাহার বিলম্ব হয় নাই। এই শিশুটিকে বনোয়ারি খুবই ভালোবাসিতে পারিত, কিন্তু ব্যাঘাতের কারণ হইল। এই যে, যত দিন যাইতে লাগিল কিরণ তাহাকে লইয়া অত্যন্ত বেশি ব্যাপৃত হইয়া পড়িল । স্ত্রীর সঙ্গে বনোয়ারির মিলনে বিস্তর ফাক পড়িতে লাগিল । বনোয়ারি স্পষ্টই বুঝিতে পারিল, এতদিন পরে কিরণ এমন একটা কিছু পাইয়াছে যাহা তাহার হৃদয়কে সত্যসত্যই