পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ V\OV কোনোদিন দেখি নি। বইয়েতে পড়েছি বটে, সেও মেয়ে-পুরুষের মধ্যে। আমার যে রূপ ছিল সে কথা আমার মনে করবার কোনো কারণ বহুকাল ঘটে নি- এতদিন পরে সেই রূপটা নিয়ে পড়ল। এই কুশ্ৰী মেয়েটি । আমার মুখ দেখে তার চােখের আশ আর মিটত না । বলত, “দিদি, তোমার এই মুখখানি আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় নি।” যেদিন আমি নিজের চুল নিজে বাধাতুম, সেদিন তার ভারি অভিমান । আমার চুলের বোঝা দুই হাত দিয়ে নাড়তে-চাড়তে তার ভারি ভালো লগত । কোথাও নিমন্ত্রণে যাওয়া ছাড়া আমার সাজগোজের তো দরকার ছিল না । কিন্তু, বিন্দু আমাকে অস্থির করে রোজই কিছু-না-কিছু সাজ করাত । মেয়েটা আমাকে নিয়ে একেবারে পাগল হয়ে উঠল । তোমাদের অন্দরমহলে কোথাও জমি এক ছটাক নেই । উত্তর দিকের পাচিলের গায়ে নর্দমার ধারে কোনো গতিকে একটা গাবগাছ জন্মেছে। যেদিন দেখতুম, সেই গাবের গাছের নতুন পাতাগুলি রাঙা টকটকে হয়ে উঠেছে, সেইদিন জানতুম, ধরাতলে বসন্ত এসেছে বটে। আমার ঘরকন্নার মধ্যে ঐ অনাদৃত মেয়েটার চিত্ত যেদিন আগাগোড়া এমন রঙিন হয়ে উঠল সেদিন আমি বুঝলুম, হৃদয়ের জগতেও একটা বসন্তের হাওয়া আছে- সে কোন স্বৰ্গ থেকে আসে, গলির মোড় থেকে আসে না । বিন্দুর ভালোবাসার দুঃসহ বেগে আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। এক একবার তার উপর রাগ হত, সে কথা স্বীকার করি, কিন্তু তার এই ভালোবাসার ভিতর দিয়ে আমি আপনার একটি স্বরূপ দেখলুম। যা আমি জীবনে আর কোনোদিন দেখি নি। সেই আমার মুক্ত স্বরূপ । এদিকে, বিন্দুর মতো মেয়েকে আমি যে এতটা আদর যত্ন করছি, এ তোমাদের অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বলে ঠেকাল । এর জন্যে খুঁতখুঁত-খিটখিটের অন্ত ছিল না । যেদিন আমার ঘর থেকে বাজুবন্ধ চুরি গেল, সেদিন সেই চুরিতে বিন্দুর যে কোনোরকমের হাত ছিল, এ কথার আভাস দিতে তোমাদের লজ হল না । যখন স্বদেশী হাঙ্গামায় লোকের বাড়িতল্লাসি হতে লাগল। তখন তোমরা অনায়াসে সন্দেহ করে বসলে যে, বিন্দু পুলিসের পোষা মেয়েচর । তার আর কোনো প্রমাণ ছিল না কেবল এই প্রমাণ যে, ও বিন্দু । তোমাদের বাড়ির দাসীরা ওর কোনোরকম কাজ করতে আপত্তি করত- তাদের কাউকে ওর কাজ করবার ফরমাশ করলে, ও-মেয়েও একেবারে সংকোচে যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠত । এই সকল কারণেই ওর জন্যে আমার খরচ বেড়ে গেল ! আমি বিশেষ করে একজন আলাদা দাসী রাখলুম। সেটা তােমাদের ভালো লাগে নি। বিন্দুকে আমি যে-সব কাপড় পরতে দিতুম তা দেখে তুমি এত রাগ করেছিলে যে, আমার হাত-খরচের টাকা বন্ধ করে দিলে । তার পরদিন থেকে আমি পাচ-সিকে দামের জোড়া মোটা কোরা কলের ধুতি পরতে আরম্ভ করে দিলুম। আর, মতির মা যখন আমার ঐটাে ভাতের থালা নিয়ে যেতে এল, তাকে বারণ করে দিলুম। আমি নিজে উঠোনের কলতলায় গিয়ে ঐটাে ভাত বাছুরকে খাইয়ে বাসন মেজেছি। একদিন হঠাৎ সেই দৃশ্যটি দেখে তুমি খুব খুশি হও নি । আমাকে খুশি না করলেও চলে আর তোমাদের খুশি না করলেই নয়, এই সুবুদ্ধিটা আজ পর্যন্ত আমার श9 (6ीका नां । এদিকে তোমাদের রাগও যেমন বেড়ে উঠছে বিন্দুর বয়সও তেমনি বেড়ে চলেছে। সেই স্বাভাবিক ব্যাপারে তোমরা অস্বাভাবিক রকমে বিব্রত হয়ে উঠেছিলে । একটা কথা মনে করে আমি আশ্চর্য হই, তোমরা জোর করে কেন বিন্দুকে তোমাদের বাড়ি থেকে বিদায় করে দাও নি। আমি বেশ বুঝি, তোমরা আমাকে মনে মনে ভয় কর । বিধাতা যে আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন, ভিতরে ভিতরে তার খাতির না করে তোমরা বাচ না । অবশেষে বিন্দুকে নিজের শক্তিতে বিদায় করতে না পেরে তোমরা প্ৰজাপতি দেবতার শরণাপন্ন হলে । বিন্দুর বর ঠিক হল । বড়ো জা বললেন, “বাঁচলুম, মা কালী আমাদের বংশের মুখ রক্ষা করলেন ।” বর কেমন তা জানি নে ; তোমাদের কাছে শুনলুম, সকল বিষয়েই ভালো। বিন্দু আমার পা জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল ; বললে, “দিদি, আমার আবার বিয়ে করা কেন ।”