পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se ○8 > প্ৰসন্ন বলিয়া একটি ছেলে আমার সঙ্গে পড়িত। সে যেমন মুখর তেমনি নিন্দুক । আমাদের পৈতৃক সততার খ্যাতিটাকে লইয়া খোচা দিবার সে ভারি সুযোগ পাইয়াছিল। বাবা আমার নাম দিয়াছিলেন সত্যধন । প্ৰসন্ন আমাদের দারিদ্র্য লক্ষ্য করিয়া বলিত, “বাবা দিবার বেলা দিলেন মিথ্যাধন, আর নামের বেলা দিলেন সত্যাধন, তার চেয়ে ধনটাকে সত্য দিয়া নামটাকে মিথ্যা দিলে লোকসান হইত। না ।” প্ৰসন্নর মুখটাকে বড়ো ভয় করিতাম । অনেকদিন তার দেখাই ছিল না । ইতিমধ্যে সে বর্ময় লুধিয়ানায় শ্ৰীীরঙ্গপত্তনে নানা রকম-বেরকমের কাজ করিয়া আসিয়াছে । সে হঠাৎ কলিকাতায় আসিয়া আমাকে পাইয়া বসিল । যার ঠাট্টাকে চিরদিন ভয় করিয়া আসিয়াছি, তার শ্রদ্ধা পাওয়া কি কম আরাম ! প্ৰসন্ন কহিল, “ভাই, আমার এই কথা রইল, দেখে নিয়ো, একদিন তুমি যদি দ্বিতীয় মতি শীল বা দুর্গাচরণ লা” না হও তবে আমি বউবাজারের মোড় হইতে বাগবাজারের মোড় পর্যন্ত বরাবর সমানে নাকে খত দিতে রাজি আছি ।” প্রসন্নর মুখে এত বড়ো কথাটা যে কতই বড়ো, তাহা প্ৰসন্নর সঙ্গে যারা এক ক্লাসে না পড়িয়াছে তারা বুঝিতেই পরিবে না। তার উপরে প্রসন্ন পৃথিবীটাকে খুব করিয়া চিনিয়া আসিয়াছে ; উহার কথার দাম আছে । সে বলিল, “কাজ বোঝে এমন লোক আমি ঢের দেখিয়াছি, দাদা- কিন্তু তারাই সব চেয়ে পড়ে বিপদে ।। তারা বুদ্ধির জোরেই কিস্তি মাত করিতে চায়, ভুলিয়া যায় যে মাথার উপরে ধর্ম আছেন । কিন্তু তোমাতে যে মণিকাঞ্চনযোগ । ধর্মকেও শক্ত করিয়া ধরিয়াছ, আবার কর্মের বুদ্ধিতেও তুমি পাকা ।” তখন ব্যাবসা-খ্যাপা কালটাও পড়িয়াছিল। সকলেই স্থির করিয়াছিল, বাণিজ্য ছাড়া দেশের মুক্তি নাই ; এবং ইহাও নিশ্চিত বুঝিয়েছিল যে, কেবলমাত্র মূলধনটার জোগাড় হইলেই উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র এবং ছাত্রদের বাপ-দাদা সকলেই এক দিনেই সকল প্রকার ব্যাবসা পুরাদমে চালাইতে পারে । আমি প্ৰসন্নকে বলিলাম, “আমার সম্বল নাই যে ।” সে বলিল “বিলক্ষণ ! তোমার পৈতৃক সম্পত্তির অভাব কী ।” তখন হঠাৎ মনে হইল, প্ৰসন্ন তবে বুঝি এতদিন ধরিয়া আমার সঙ্গে একটা লম্বা ঠাট্টা করিয়া আসিতেছে । প্ৰসন্ন কহিল, “ঠাট্টা নয়, দাদা । সততাই তো লক্ষ্মীর সোনার পদ্ম । লোকের বিশ্বাসের উপরই কারবার চলে, টাকায় নয় ।” পিতার আমল হইতেই আমাদের বাড়িতে পাড়ার কোনো কোনো বিধবা মেয়ে টাকা গচ্ছিত রাখিত । তারা সুদের আশা করিত না, কেবল এই বলিয়া নিশ্চিন্ত ছিল যে, মেয়েমানুষের সর্বত্রই ঠকিবার আশঙ্কা আছে, কেবল আমাদের ঘরেই নাই । সেই গচ্ছিত টাকা লইয়া স্বদেশী এজেন্সি খুলিলাম। কাপড়, কাগজ, কালি, বোতাম, সাবান, যতই আনাই, বিক্রি হইয়া যায়- একেবারে পঙ্গপালের মতো খরিদার আসিতে লাগিল । একটা কথা আছে- বিদ্যা যতই বাড়ে ততই জানা যায় যে, কিছুই জানি না। টাকারও সেই দশা । টাকা যতই বাড়ে ততই মনে হয়, টাকা নাই বলিলেই হয় । আমার মনের সেই রকম অবস্থায় প্রসন্ন বলিল- ঠিক যে বলিল তাহা নয়, আমাকে দিয়া বলাইয়া লইল যে, খুচরা-দোকানদারির কাজে জীবন দেওয়াটা জীবনের বাজে খরচ । পৃথিবী জুড়িয়া যে-সব ব্যাবসা সেই তো ব্যাবসা । দেশের ভিতরেই যে টাকা খাটে সে টাকা ঘানির বলদের মতো অগ্রসর হয় না, কেবল ঘুরিয়া মরে । প্রসন্ন এমনি ভক্তিতে গদগদ হইয়া উঠিল যেন এমন নুতন অথচ গভীর জ্ঞানের কথা সে জীবনে আর কখনো শোনে নাই । তার পরে আমি তাকে ভারতবর্ষের তিসির ব্যাবসার সাত বছরের হিসাব দেখাইলাম। কোথায় তিসি কত পরিমাণে যায় ; কোথায় কত দর ; দীর সব চেয়ে উঠেই বা কত,