পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8V রবীন্দ্র-রচনাবলী পরের স্বভাব সংশোধন আমার কৌলিক কাজ ; ইহাতে আমার পটুতাও যেমন উৎসাহও তেমনি । সুবোধের স্বভাবটা কর্মপটু নয় বলিয়াই আমি তাকে খুব কবিয়া কাজ করাইতে লাগিলাম। যতবারই সে ভুল করিত ততবারই নিজেকে দিয়া তার সে ভুল শোধরাইয়া লইতাম । আবার তার আর-এক অভ্যাস, সেটা তার মায়েরও ছিল- সে আপনাকে এবং আপনার চারি দিককে নানা রকম করিয়া কল্পনা করিত । জানলার সামনেই যে জামরুল গাছ ছিল সেটাকে সে কী একটা অদ্ভুত নাম দিয়াছিল ; স্ত্রীর কাছে শুনিয়াছি একলা দাড়াইয়া সেই গাছটার সঙ্গে সে কথা কহিত । বিছানাটাকে মাঠ, আর বালিশগুলাকে গোরুর পাল মনে করিয়া শোবার ঘরে বসিয়া রাখালি করাটা যে কত মিথ্যা, ইহা তার নিজের মুখে কবুল করাইবার অনেক চেষ্টা করিয়াছি- সে জবাবই করে না। আমি যতই তাকে শাসন করি আমার কাছে তার ত্রুটি ততই বাড়িয়া চলে। আমাকে দেখিলেই সে থিতামত খাইয়া যায় ; আমার মুখের সাদা কথাটাও সে বুঝিতে পারে না । আর কিছু নয়, হৃদয় যদি রাগ করিতে শুরু করে এবং নিজেকে সামলাইবার মতো বাহির হইতে কোনো ধাক্কা যদি না সে পায় তবে রাগটা আপনাকে আপনিই বাড়াইয়া চলে, নূতন কারণের অপেক্ষা রাখে না। যদি এমন মানুষকে দু-চারবার মুখ বলি যার জবাব দিবার সাধ্য নাই। তবে সেই দু-চারবার বলাটাই পঞ্চমবারকার বলাটাকে সৃষ্টি করে, কোনো উপকরণের দরকার হয় না । সুবোধের উপর কেবলই বিরক্ত হইয়া ওঠা। আমার মনের এমনি অভ্যাস হইয়াছিল যে, সেটা ত্যাগ করা আমার সাধ্যই छिल •ा | এমনি করিয়া পাঁচ বছর কাটিল । সুবােধের বয়স যখন বারো তখন তার কোম্পানির কাগজ এবং গহনাপত্র গলিয়া গিয়া আমার হিসাবের খাতার গোটকতক কালির অঙ্কে পরিণত হইল । মনকে বুঝাইলাম, অনু তো উইলে আমাকেই টাকা দিয়াছে। মাঝখানে সুবোধ আছে বটে, কিন্তু ও তো ছায়া, নাই বলিলেই হয় । যে টাকাটা নিশ্চয়ই পাইব সেটাকে আগেভাগে খরচ করিলে অধৰ্ম হয় N অল্প বয়স হইতেই আমার বাতের ব্যামো ছিল । কিছুদিন হইতে সেইটো অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে। যারা কাজের লোক তাদের স্থির করিয়া রাখিলে তারা চারি দিকের সমস্ত লোককে অস্থির করিয়া তোলে । সে কয়দিন আমার স্ত্রী, আমার ছেলে, সুবোধ, বাড়ির চাকর-বাকর কারও শান্তি ছিল না । এদিকে আমার পরিচিত যে কয়জন বিধবা আমার কাছে টাকা রাখিয়াছিল। কয়েক মাস তাদের সুদ বন্ধ। পূর্বে এমন কখনো ঘটিতে দিই নাই। এইজন্য তারা উদবিগ্ন হইয়া আমাকে তাগিদ করিতেছে। আমি প্ৰসন্নকে তাগিদ করি, সে কেবলই দিন ফিরায় । অবশেষে যেদিন নিশ্চিত দিবার কথা সেদিন সকাল হইতে পাওনাদাররা বসিয়া আছে, প্ৰসন্নর দেখা নাই । নিত্যকে বলিলাম, “সুবোধকে ডাকিয়া দাও।” সে বলিল, “সুবোধ শুইয়া আছে।” আমি মহা রাগিয়া বলিলাম, “শুইয়া আছে ? এখন বেলা এগারোটা, এখন সে শুইয়া আছে ?” সুবোধ ভয়ে ভয়ে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি বলিলাম, “প্ৰসন্নকে যেখানে পাও ডাকিয়া আনে ৷” সর্বদা আমার ফাইফরমাশ খাটিয়া সুবোধ এ-সকল কাজে পাকা হইয়াছিল। কাকে কোথায় সন্ধান করিতে হইবে, সমস্তই তার জানা । বেলা একটা হইল, দুটা হইল, তিনটা হইল, সুবোধ আর ফেরে না । এদিকে যারা ধন্না দিয়া বসিয়া আছে তাদের ভাষার তাপ এবং বেগ বাড়িয়া উঠিতে লাগিল । কোনোমতেই সুবোধটার গড়িমসি চাল ঘুচাইতে পারিলাম না । যত দিন যাইতেছে ততই তার ঢিলামি আরো যেন বাড়িয়া উঠিতেছে। আজকাল সে বসিতে পারিলে উঠিতে চায় না, নড়িতে-চড়িতে তার সাত দিন লাগে । এক-একদিন দেখি, বিকালে পাচটার সময়েও সে বিছানায় গড়াইতেছে- সকালে তাকে বিছানা হইতে জোর করিয়া