পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\OGO রবীন্দ্র-রচনাবলী বাপের বাড়ি যাইবার প্রসঙ্গে মণি কাদিয়াছে- এই খবরে যতীন বিচলিত হইয়া বালিশটাকে পিঠের কাছে টানিয়া তুলিল এবং একটু উঠিয়া হেলান দিয়া বসিল । বলিল, “মাসি, এই জানলাটা আর-একটু খুলে দাও, আর এই আলোটা এ ঘরে দরকার নেই।” জানলা খুলিতেই স্তব্ধ রাত্রি অনন্ত তীর্থপথের পথিকের মতো রোগীর দরজার কাছে চুপ করিয়া দাড়াইল । কত যুগের কত মৃত্যুকালের সাক্ষী ঐ তারাগুলি যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল । যতীন এই বৃহৎ অন্ধকারের পটের উপর তাহার মণির মুখখানি দেখিতে পাইল । সেই মুখের ডাগর দুটি চক্ষু মোটা মোটা জলের ফোটায় ভরা— সে জল যেন আর শেষ হইল না, চিরকালের জন্য उड़िशा अश्व्नि । অনেকক্ষণ সে চুপ করিয়া আছে দেখিয়া মাসি নিশ্চিন্ত হইলেন । ভাবিলেন, যতীনের ঘুম আসিয়াছে । এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “মাসি, তোমরা কিন্তু বরাবর মনে করে এসেছ, মণির মন চঞ্চল, আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি । কিন্তু দেখো-” “না, বাবা, ভুল বুঝেছিলুম— সময় হলেই মানুষকে চেনা যায় !” יו וקוצ' “যতীন, ঘুমোও, বাবা ।” “আমাকে একটু ভাবতে দাও, একটু কথা কইতে দাও ! বিরক্ত হােয়ো না মাসি।” “আচ্ছা, বলো, বাবা ।” Na “আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতেই কত সময় লাগে ! একদিন যখন মনে করতুম, আমরা কেউ মণির মন পেলুম না, তখন চুপ করে সহ্য করেছি। তোমরা তখন—” “না, বাবা, অমন কথা বোলো না- আমিও সহ্য করেছি। ” “মন তো মাটির ঢেলা নয়, কুড়িয়ে নিলেই তো নেওয়া যায় না । আমি জানতুম, মণি নিজের মন এখনো বোঝে নি ; কোনো একটা আঘাতে যেদিন বুঝবে সেদিন আর-” “ঠিক কথা, যতীন ।” “সেইজন্যই ওর ছেলেমানুষিতে কোনোদিন কিছু মনে করি নি।” মাসি এ কথার কোনো উত্তর করিলেন না ; কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন । কতদিন তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাট আসিয়াছে। তবু ঘরে যায় নাই । কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া ; একান্ত ইচ্ছা, মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয় । মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়োজন করিতেছে । তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে । সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা তিনি জানিতেন । কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন ‘বাবা, তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়ে না- ও একটু চাহিতে শিখুক- মানুষকে একটু কাদানো চাই ।” কিন্তু এ-সব কথা বলিবার নহে, বলিলেও কেহ বোঝে না। যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে। সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে, এ কথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই পূজা চলিতেছিল, অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আশা পরাভব মানিতেছিল না । মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে, এমন সময়ে হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি। তাই তার উপর রাগ করতে । কিন্তু, মাসি, সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতো, সমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাক থেকে যায় । জীবনে কত ভুল করি, কত ভুল বুঝি, তবু তার ফঁাকে ফঁাকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি ।