পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V6V রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী “মাসি, ডাক্তার বুঝি নীচের ঘরে ?” “হা, যতীন, আজ রাত্রে থাকবেন ।” “কিন্তু আমাকে যেন মিছামিছি ঘুমের ওষুধ দেওয়া না হয় । দেখেছ তো, ওতে আমার ঘুম হয় না, কেবল কষ্ট বাড়ে । আমাকে ভালো করে জেগে থাকতে দাও । জান, মাসি ? বৈশাখ-দ্বাদশীর রাত্রে আমাদের বিয়ে হয়েছিল- কাল সেই দ্বাদশী আসছে- কাল সেইদিনকার রাত্রে সব তারা আকাশে জ্বালানো হবে । মণির বোধ হয় মনে নেই- আমি তাকে সেই কথাটি আজ মনে করিয়ে দিতে চাই ; কেবল তাকে তুমি দু মিনিটের জন্যে ডেকে দাও । চুপ ক’রে রইলে কেন । বোধ হয় ডাক্তার তোমাদের বলেছে, আমার শরীর দুর্বল, এখন যাতে আমার মনে কোনো- কিন্তু, আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি, মাসি, আজ রাত্রে তার সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিতে পারলে আমার মন খুব শান্ত হয়ে যাবে- তা হলে বোধ হয়। আর ঘুমোবার ওষুধ দিতে হবে না। আমার মন তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে ব’লেই, এই দু রাত্রি আমার ঘুম হয় নি। মাসি, তুমি আমন করে কেঁদো না । আমি বেশ আছি, আমার মন আজ যেমন ভরে উঠেছে, আমার জীবনে এমন আর কখনোই হয় নি। সেইজন্যই আমি মণিকে ডাকছি। মনে হচ্ছে, আজ যেন আমার ভরা হৃদয়টি তার হাতে দিয়ে যেতে পারব । তাকে অনেক দিন অনেক কথা বলতে চেয়েছিলুম, বলতে পারি নি, কিন্তু আর এক মুহুর্ত দেরি করা নয়, তাকে এখনি ডেকে দাও- এর পরে আর সময় পাব না । না, মাসি, তোমার ঐ কান্না আমি সইতে পারি। নে । এতদিন তো শান্ত ছিলে, আজ কেন তোমার এমন হল ।” “ওরে যতীন, ভেবেছিলুম, আমার সব কান্না ফুরিয়ে গেছে- কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, এখনো বাকি আছে, আজ আর পারছি নে ৷” “মণিকে ডেকে দাও- তাকে বলে দেব কালকের রাতের জন্যে যেন-” “যাচ্ছি, বাবা। শস্তু দরজার কাছে রইল, যদি কিছু দরকার হয় ওকে ডেকো ।” মাসি মণির শোবার ঘরে গিয়া মেজের উপর বসিয়া ডাকিতে লাগিলেন, “ওরে, আয়- একবার আয়- আয় রে রাক্ষসী, যে তোকে তার সব দিয়েছে তার শেষ কথাটি রাখ- সে মরতে বসেছে, তাকে আর মারিস নে ৷” যতীন পায়ের শব্দে চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “মণি !” “না, আমি শভু । আমাকে ডাকছিলেন ?” “একবার তোর বউঠাকরুনকে ডেকে দে ।” “কাকে ?” “বউঠাকরুনকে । “তিনি তো এখনো ফেরেন নি ।” “কোথায় গেছেন ?” “সীতারামপুরে ।” “আজ গেছেন ?” “না, আজ তিন দিন হল গেছেন ।” ক্ষণকালের জন্য যতীনের সর্বাঙ্গ বিমঝিম করিয়া আসিল- সে চোখে অন্ধকার দেখিল । এতক্ষণ বালিশে ঠেসান দিয়া বসিয়াছিল, শুইয়া পড়িল । পায়ের উপর সেই পশমের শাল ঢাকা ছিল, সেটা পা দিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল । অনেকক্ষণ পরে মাসি যখন আসিলেন যতীন মণির কথা কিছুই বলিল না। মাসি ভাবিলেন, সে কথা উহার মনে নাই ।