পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

v.)ԳԵր রবীন্দ্র-রচনাবলী সংসারে অধিকাংশ বড়ো বড়ো জীবননাট্য যবনিকায় আড়ালেই জমতে থাকে, পঞ্চমান্ধের শেষে সেই যবনিকা হঠাৎ উঠে যায়। আমি যখন আমার দ্বৈতাদের নিয়ে বের্গসঁর তত্ত্বজ্ঞান ও ইবসেনের মনস্তত্ত্ব আলোচনা করছি তখন মনে করেছিলুম, অনিলার জীবনযজ্ঞবেদীতে কোনো আগুনই বুঝি জ্বলে নি । কিন্তু, আজকে যখন সেই অতীতের দিকে পিছন ফিরে দেখি তখন স্পষ্ট দেখতে পাই, যে-সৃষ্টিকর্তা আগুনে পুড়িয়ে, হাতুড়ি পিটিয়ে, জীবনের প্রতিমা তৈরি করে থাকেন আনিলার মর্মস্থলে তিনি খুবই সজাগ ছিলেন। সেখানে একটি ছোটাে ভাই, একটি দিদি এবং একটি বিমাতার সমাবেশে নিয়তই একটা ঘাতপ্রতিঘাতের লীলা চলছিল । পুরাণের বাসুকী যে পৌরাণিক পৃথিবীকে ধরে আছে সে পৃথিবী স্থির। কিন্তু, সংসারে যে-মেয়েকে বেদনার পৃথিবী বহন করতে হয় তার সে-পৃথিবী মুহুর্তে মুহুর্তে নূতন নূতন আঘাতে তৈরি হয়ে উঠছে। সেই চলতি ব্যথার ভার বুকে নিয়ে যাকে ঘরকন্নার খুঁটিনাটির মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন চলতে হয়, তার অন্তরের কথা অন্তর্যামী ছাড়া কে সম্পূর্ণ বুঝবে । অন্তত, আমি তো কিছুই বুঝি নি। কত উদবেগ, কত অপমানিত প্ৰয়াস, পীড়িত মেহের কত অন্তৰ্গঢ় ব্যাকুলতা, আমার এত কাছে নিঃশব্দতার অন্তরালে মথিত হয়ে উঠছিল। আমি তা জানিই নি । আমি জানতুম, যেদিন দ্বৈতদলের ভোজের বার উপস্থিত হত সেইদিনকার উদ্যোগপর্বই আনিলার জীবনের প্রধান পর্ব। আজ বেশ বুঝতে পারছি, পরম ব্যথার ভিতর দিয়েই এ সংসারে এই ছোটাে ভাইটিই দিদির সব চেয়ে অন্তরতম হয়ে উঠেছিল । সরোজকে মানুষ করে তোলা সম্বন্ধে আমার পরামর্শ ও সহায়তা এরা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক বলে উপেক্ষা করাতে আমি ওদিকটাতে একেবারে তাকাই নি, তার যে কিরকম চলছে সে কথা কোনোদিন জিজ্ঞাসাও করি নি । ইতিমধ্যে আমাদের গলির পয়লা-নম্বর বাড়িতে লোক এল । এ বাড়িটি সেকালের বিখ্যাত ধনী মহাজন উদ্ধব বড়ালের আমলে তৈরি । তার পরে দুই পুরুষের মধ্যে সে বংশের ধন জন প্ৰায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে, দুটি-একটি বিধবা বাকি আছে। তারা এখানে থাকে না, তাই বাড়িটা পোড়ো অবস্থাতেই আছে । মাঝে মাঝে বিবাহ প্ৰভৃতি ক্রিয়াকাণ্ডে এ বাড়ি কেউ কেউ অল্পদিনের জন্যে ভাড়া নিয়ে থাকে, বাকি সময়টা এত বড়ো বাড়ির ভাড়াটে প্ৰায় জোটে না । এবারে এলেন, মনে করো, তার নাম রাজা সিতাংশুমৌলী, এবং ধরে নেওয়া যাক, তিনি নরোত্তমপুরের জমিদার । আমার বাড়ির ঠিক পাশেই অকস্মাৎ এতবড়ো একটা আবির্ভাব আমি হয়তো জানতেই পারতুম না। কারণ, কৰ্ণ যেমন একটি সহজ কবচ গায়ে দিয়েই পৃথিবীতে এসেছিলেন আমারও তেমনি একটি বিধিদত্ত সহজ কবচ ছিল । সেটি হচ্ছে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা । আমার এ বর্মটি খুব মজবুত ও মোটা । অতএব সচরাচর পৃথিবীতে চারি দিকে যে-সকল ঠেলা ঠেলি গোলমাল গালমন্দ চলতে থাকে তার থেকে আত্মরক্ষা করবার উপকরণ আমার ছিল । কিন্তু, আধুনিক কালের বড়োমানুষরা স্বাভাবিক উৎপাতের চেয়ে বেশি, তারা অস্বাভাবিক উৎপাত । দু হাত, দু পা, এক মুণ্ড যাদের আছে তারা হল মানুষ ; যাদের হঠাৎ কতকগুলো হাত পা মাথামুণ্ড বেড়ে গেছে তারা হল দৈত্য । অহরহ দুদাড় শব্দে তারা আপনার সীমাকে ভাঙতে থাকে এবং আপনি বাহুল্য দিয়ে স্বৰ্গমর্তকে অতিষ্ঠা করে তোলে । তাদের প্রতি মনোযোগ না দেওয়া অসম্ভব । যাদের পরে মন দেবার কোনোই প্রয়োজন নেই। অথচ মন না দিয়ে থাকবারও জো নেই তারাই হচ্ছে জগতের অস্বাস্থ্য, স্বয়ং ইন্দ্ৰ ‘পর্যন্ত তাদের ভয় করেন । মনে বুঝলুম, সিতাংশুমীেলী সেই দলের মানুষ । একা একজন লোক যে এত বেজায় অতিরিক্ত হতে পারে, তা আমি পূর্বে জানতুম না । গাড়ি ঘোড়া লোক লস্কর নিয়ে সে যেন দশ-মুণ্ড বিশ-হাতের পালা জমিয়েছে। কাজেই তার জ্বালায় আমার সারস্বত স্বৰ্গলোকটির বেড়া রোজ ভাঙতে লাগিল । তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আমাদের গলির মোড়ে । এ গলিটার প্রধান গুণ ছিল এই যে, আমার মতো আনমনা লোক সামনের দিকে না তাকিয়ে, পিঠের দিকে মন না দিয়ে, ডাইনে বঁায়ে ভূক্ষেপমাত্র না করেও এখানে নিরাপদ বিচরণ করতে পারে। এমন-কি, এখানে সেই পথ-চলতি অবস্থায় মেরেডিথের গল্প, ব্রাউনিঙের কাব্য অথবা আমাদের কোনো আধুনিক বাঙালি কবির রচনা