পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Jr 8. রবীন্দ্র-রচনাবলী কে, সে কথা লেখবার দরকার নেই, কিন্তু নিশ্চয়ই তা তোমার মনের কাছে গোপন থাকবে না ।” এমন পঁচিশখানি চিঠি । এর কোনো চিঠির উত্তর যে অনিলের কাছ থেকে গিয়েছিল, এ চিঠিগুলির মধ্যে তার কোনো নিদর্শন নেই। যদি যেত তা হলে তখনি বেসুর বেজে উঠত- কিংবা তা হলে সোনার কাঠির জাদু একেবারে ভেঙে স্তবগান নীরব হত । কিন্তু, এ কী আশ্চর্য । সিতাংশু যাকে ক্ষণকালের ফাক দিয়ে দেখেছে, আজ আট বছরের ঘনিষ্ঠতার পর এই পরের চিঠিগুলির ভিতর দিয়ে তাকে প্রথম দেখলুম। আমার চোখের উপরকার ঘুমের পর্দা কত মোটা পর্দা না জানি ! পুরোহিতের হাত থেকে আনিলাকে আমি পেয়েছিলুম, কিন্তু তার বিধাতার হাত থেকে তাকে গ্ৰহণ করবার মূল্য আমি কিছুই দিই নি। আমি আমার দ্বৈতদলকে এবং নব্যন্যায়কে তার চেয়ে অনেক বড়ো করে দেখেছি । সুতরাং যাকে আমি কোনো দিনই দেখি নি, এক নিমেষের জন্যও পাই নি, তাকে আর-কেউ যদি আপনার জীবন উৎসর্গ করে পেয়ে থাকে। তবে কী বলে কার কাছে আমার ক্ষতির নালিশ করব । শেষ চিঠিখানা এই-- “বাইরে থেকে আমি তোমার কিছুই জানি নে, কিন্তু অন্তরের দিক থেকে আমি দেখেছি তোমার বেদনা। এইখানে বড়ো কঠিন আমার পরীক্ষা । আমার এই পুরুষের বাহু নিশ্চেষ্ট থাকতে চায় না । ইচ্ছা করে, স্বৰ্গমর্তের সমস্ত শাসন বিদীর্ণ করে তোমাকে তোমার জীবনের ব্যর্থতা থেকে উদ্ধার করে আনি । তার পরে এও মনে হয়, তোমার দুঃখই তোমার অন্তর্যামীর আসন । সেটি হরণ করবার অধিকার আমার নেই । কাল ভোরবেলা পর্যন্ত মেয়াদ নিয়েছি । এর মধ্যে যদি কোনো দৈববাণী আমার এই দ্বিধা মিটিয়ে দেয় তা হলে যা হয় একটা কিছু হবে । বাসনার প্রবল হাওয়ায় আমাদের পথ চলবার প্রদীপকে নিবিয়ে দেয় । তাই আমি মনকে শান্ত রাখব- একমনে এই মন্তর জপ করব যে, তোমার কল্যাণ হোক ৷” বোঝা যাচ্ছে দ্বিধা দূর হয়ে গেছে— দুজনার পথ এক হয়ে মিলেছে। মাঝের থেকে সিতাংশুর লেখা এই চিঠিগুলি আমারই চিঠি হয়ে উঠল- ওগুলি আজ আমারই প্ৰাণের স্তবমন্ত্র । কত কাল চলে গেল, বই পড়তে আর ভালো লাগে না । অনিলকে একবার কোনোমতে দেখবার জন্যে মনের মধ্যে এমন বেদনা উপস্থিত হল কিছুতেই স্থির থাকতে পারলুম না । খবর নিয়ে জানলুম সিতাংশু তখন মসূরি-পাহাড়ে । সেখানে গিয়ে সিতাংশুকে অনেকবার পথে বেড়াতে দেখেছি, কিন্তু তার সঙ্গে তো অনিলকে দেখি নি । ভয় হল পাছে তাকে অপমান ক’রে ত্যাগ করে থাকে । আমি থাকতে না পেরে একেবারে তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করলুম। সব কথা বিস্তারিত করে লেখবার দরকার নেই। সিতাংশু বললে, “আমি তার কাছ থেকে জীবনে কেবল একটিমাত্র চিঠি পেয়েছি- সেটি এই দেখুন।” এই বলে সিতাংশু তার পকেট থেকে একটি ছোটাে এনামোল-করা সোনার কার্ডকেস খুলে তার ভিতর থেকে এক-টুকরো কাগজ বের করে দিলে । তাতে লেখা আছে, “আমি চললুম, আমাকে খুঁজতে চেষ্টা কোরো না । করলেও খোজ পাবে না ।” সেই অক্ষর সেই লেখা, সেই তারিখ এবং যে নীলরঙের চিঠির কাগজের অর্ধেকখানা আমার কাছে এই টুকরোটি তারই বাকি অর্ধেক । Wikis »\o88