পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 OO রবীন্দ্র-রচনাবলী কাছে তারই প্ৰাপ্তিস্বীকার করতে এসেছে । জেল থেকে বেরিয়ে অনেক সভায় অনেক মালা পেয়েছি, কিন্তু আজ ঘরের কোণে এই-যে অখ্যাত হাতের মানটুকু পেলেম এ আমার হৃদয়ে এসে বাজল । নিস্ত্ৰৈগুণ্য হবার উমেদার এই জেল-খাটা পুরুষের বহুকালের শুকনো চোখ ভিজে ওঠবার উপক্রম করলে । পূর্বেই বলেছি সেবায় আমার অভ্যোস নেই। কেউ পা টিপে দিতে এলে ভালোই লগত না, ধমকে তাড়িয়ে দিতেম। আজ এই সেবা প্ৰত্যাখ্যান করার স্পর্ধা মনেও উদয় হল না । খুলনা জেলায় পিসিমার আদি শ্বশুরবাড়ি । সেখানকার গ্রামসম্পর্কের দুটি-চারটি মেয়েকে পিসিমা আনিয়ে রেখেছেন । পিসিমার কাজকর্মে পূজা-অৰ্চনায় তারা ছিল তার সহকারিণী । তার নানারকম ক্রিয়াকর্মে তাদের না হলে তার চলত না । এ বাড়িতে আর সর্বত্রই অমিয়ার অধিকার ছিল, কেবল পুজোর ঘরে না । অমিয়া তার কারণ জানত না, জানিবার চেষ্টাও করত না । পিসিমার মনে ছিল, অমিয়া ভালোরকম লেখাপড়া শিখে এমন ঘরে বিয়ে করবে। যেখানে আচার-বিচারের বাধাৰ্বিাধি নেই, আর দেবদ্বিজ যেখান থেকে খাতির না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসেন । এটা আক্ষেপের কথা । কিন্তু, এ ছাড়া ওর আর-কোনো গতি হতেই পারে না- বাপের পাতক থেকে মেয়েকে সম্পূর্ণ বাচাবে কে । সেই কারণে অমিয়াকে তিনি টিলেমির ঢালু তট বেয়ে আধুনিক আচারহীনতার মধ্যে উত্তীর্ণ হতে বাধা দেন নি । ছেলেবেলা থেকে অঙ্কে আর ইংরেজিতে ক্লাসে সে হয়েছে। ফাস্ট । বছরে বছরে মিশনারি ইস্কুল থেকে ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে চারটি-পাঁচটা করে প্রাইজ নিয়ে এসেছে। যে-বারে দৈবাৎ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছে সে-বারে শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে ; প্ৰায়োপবেশন করতে যায় আর-কি। এমনি করে পরীক্ষাদেবতার কাছে সিদ্ধির মানত করে সে তারই সাধনায় দীর্ঘকাল তন্ময় ছিল। অবশেষে অসহযোগের যোগিনীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পরীক্ষাদেবীর বর্জন-সাধনাতেও সে প্ৰথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হল । পাস-গ্রহণেও যেমন, পাস-ছেদনেও তেমনি, কিছুতেই সে কারও চেয়ে পিছিয়ে থাকবার মেয়ে নয়। পড়াশুনো করে তার যে খ্যাতি, পড়াশুনো ছেড়ে তার চেয়ে খ্যাতি অনেক বেশি বেড়ে গেল । আজ যে-সব প্ৰাইজ তার হাতের কাছে ফিরছে। তারা চলে, তারা বলে, তারা অশ্রুসলিলে গলে, তারা কবিতাও লেখে | বলা বাহুল্য, পিসিমার পাড়া গেয়ে পোষ্য মেয়েগুলির পরে অমিয়ার একটুও শ্রদ্ধা ছিল না ; অনাথাসদনে, যে-সময়ে চাদার টাকার চেয়ে অনাথারই অভাব বেশি, সেই সময়ে এই মেয়েদের সেখানে পাঠাবার জন্যে পিসিমার কাছে অমিয়া অনেক আবেদন করেছে । পিসিমা বলেছেন, “সে কী কথা- এরা তো অনাথ নয়, আমি বেঁচে আছি কী করতে । অনাথ হোক, সনাথ হোক, মেয়েরা চায় ঘর ; সাদনের মধ্যে তাদের ছাপ মেরে বস্তাবন্দী করে রাখা কেন । তোমার যদি এতই দয়া থাকে তোমার ঘর নেই নাকি ৷” যা হােক, মেয়েটি যখন মাথা হেঁট করে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আমি সংকুচিত অথচ বিগলিতচিত্তে একখানা খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে বিজ্ঞাপনের উপর চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলেম । এমন সময় হঠাৎ অকালে অমিয়া ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত ; নবযুগের উপযোগী ভাইফোটার একটা নূতন ব্যাখ্যা সে লিখেছে। সেইটে ইংরেজিতেও সে প্রচার করতে চায় ; আমার কাছে তারই সাহায্য আবশ্যক । এই লেখাটির ওরিজিনাল আইডিয়াতে ভক্তদল খুব বিচলিত— এই নিয়ে তারা একটা ধুমধাম করবে বলে কোমর বেঁধেছে। ঘরে ঢুকেই সেবানিযুক্ত মেয়েটিকে দেখেই অমিয়ার মুখের ভাব অত্যন্ত শক্ত হয়ে উঠল । তার দেশবিশ্রাত দাদা যদি একটু ইশারামাত্র করত তা হলে তার সেবা করবার লোকের কি অভাব ছিল । এত মানুষ থাকতে শেষকালে কি এই-- থাকতে পারলে না। বললে, “দাদা, হরিমতিকে কি তুমি-” প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়ে ফস করে বলে ফেললেম, “পায়ে বড়ো ব্যথা করছিল ।” পুলিস-সার্জেন্টের হাতে একটি মেয়ের অপমান বাচাতে গিয়ে জেলখানায় গিয়েছিলেম । আজ এক মেয়ের আক্রোশ থেকে আর-এক মেয়েকে আচ্ছাদন করবার জন্যে মিথ্যে কথা বলে ফেললেম ।