পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8 SA রচনায় আমল না দেয়। তবে বুঝিতে হইবে, বাস্তবতা সম্বন্ধে তাহার বোধশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ । এই বুঝিয়া লিখিলাম পৈতা সংহার-কাব্য । তাহার বস্তুপিণ্ডটা ওজনে কম হইল না, কিন্তু হায় রে, সরস্বতী কি বস্তুপিণ্ডের উপরে তাহার আসন রাখিয়াছেন না পদ্মের উপরে ? এই দৃষ্টান্তটি দিবার একটু হেতু আছে। বিচারকদের মতে, বাস্তবতা জিনিসটা কী তাহার একটা সূত্র ধরিতে পারিয়াছি । আমার বিরুদ্ধে একজন ফরিয়াদি বলিয়াছেন, আমার সমস্ত রচনার মধ্যে বাস্তবতার উপকরণ একটু যেখানে জমা হইয়াছে সে কেবল “গোরা' উপন্যাসে । , গোরা উপন্যাসে কী বস্তু আছে না-আছে উক্ত উপন্যাসের লেখক তাহা সব চেয়ে কম বোঝে । লোকমুখে শুনিয়াছি, প্রচলিত হিন্দুয়ানির ভালো ব্যাখ্যা তাহার মধ্যে পাওয়া যায় । ইহা হইতে আন্দাজ করিতেছি, ওটাই একটা বাস্তবতার লক্ষণ । বর্তমান সময়ে কতকগুলি বিশেষ কারণে হিন্দু আপনার হিন্দুত্ব লইয়া ভয়ংকর রুখিয়া উঠিয়াছে। সেটা সম্বন্ধে তাহার মনের ভাব বেশ সহজ অবস্থায় নাই। বিশ্বরচনায় এই হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি এবং এই সৃষ্টিতেই তিনি তাহার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করিয়া আর-কিছুতেই অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না, এইটে আমাদের বুলি । সাহিত্যের বাস্তবতা ওজনের সময়ে এই বুলিটা হয় বাটখারা । কালিদাসকে আমরা ভালো বলি, কেননা তাহার কাব্যে হিন্দুত্ব আছে। বঙ্কিমকে আমরা ভালো বলি, কেননা স্বামীর প্রতি হিন্দুরমণীর যেরূপ মনোভাব হিন্দুশাস্ত্রসম্মত তাহা তাহার নায়িকাদের মধ্যে দেখা যায় ; অথবা নিন্দা করি, সেটা যথেষ্ট পরিমাণে নাই বলিয়া । অন্য দেশেও এমন ঘটে । ইংলন্ডে ইস্পীরিয়ালিজমের জ্বরোত্তাপ যখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় চড়িয়া উঠিতেছিল তখন একদল ইংরেজ কবির কাব্যে তাহারই রক্তবর্ণ বাস্তবতা প্ৰলাপ বকিতেছিল । তাহার সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়। তবে ওয়ার্ডস্বার্থের কবিতায় বাস্তবতা কোথায় । তিনি বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে যে একটি আনন্দময় আবির্ভাব দেখিতে পাইয়াছিলেন তাহার সঙ্গে ব্রিটিশ জনসাধারণের শিক্ষা-দীক্ষা-অভ্যাস-আচার-বিচারের যোগ ছিল কোথায় । তাহারা ভাবের রাগিণীটি নির্জনবাসী একলা-কবির চিত্তবাশিতে বাজিয়াছিল- ইংরেজের স্বদেশী হাটে ওজনদরে যাহা বিক্রি হয় এমনতরো বস্তুপিণ্ড তাহার মধ্যে কী আছে জানিতে চাই । আর, কীটুস, শেলি- ইহাদের কাব্যের বাস্তবতা কী দিয়া নির্ধারণ করিব । ইংরেজের জাতীয় চিত্তের সুরের সঙ্গে সুর মিলাইয়া কি ইহারা বকশিশ ও বাহবা পাইয়াছিলেন । যে-সমস্ত সমালোচক সাহিত্যের হাটে বাস্তবতার দালালি করিয়া থাকেন তাহারা ওয়ার্ডস্বার্থের কবিতার কিরূপ সমাদর করিয়াছিলেন তাহা ইতিহাসে আছে। শেলিকে অস্পৃশ্য অস্ত্যজের মতো তাহার দেশ সেদিন ঘরে ঢুকিতে দেয় নাই এবং কীটুসকে মৃত্যুবাণ মারিয়াছিল। আরো আধুনিক দৃষ্টান্ত টেনিসন । তিনি ভিক্টোরীয় যুগের প্রচলিত লোকধর্মের কবি । তাই তাহার প্রভাব দেশের মধ্যে সর্বব্যাপী ছিল । কিন্তু, ভিক্টোরীয় যুগের বাস্তবতা যত ক্ষীণ হইতেছে টেনিসনের আসনও তত সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছে । তাহার কাব্য যে গুণে টিকিবে তাহা নিত্যরসের গুণে, ತೌ ব্রিটিশ বস্তু বহুল পরিমাণে আছে বলিয়া নহে- সেই স্কুল বস্তুটাই প্রতিদিন ধসিয়া আমাদের কালের লেখকদের মোটা অপরাধটা এই যে, আমরা ইংরেজি পড়িয়াছি । ইংরেজি শিক্ষা বাঙালির পক্ষে বাস্তব নহে, অতএব তাহা বাস্তবতার, কারণও নহে, আর সেইজন্যই এখনকার সাহিত্য দেশের লোকসাধারণকে শিক্ষা ও আনন্দ দিতে পারে না । . উত্তম কথা । কিন্তু, দেশের যে-সব লোক ইংরেজি শেখে নাই তাহদের তুলনায় আমাদের সংখ্যা তো নগণ্য। কেহ তাহাদের তো কলম কড়িয়া লয় নাই । আমরা কেবল আমাদের অবাস্তবতার জোরে দেশের সমস্ত বাস্তবিকদের চেয়ে জিতিয়া যাইব, ইহা স্বভাবের নিয়ম নহে । হয়তো উত্তরে শুনিব, আমরা হারিতেছি । ইংরেজি যাহারা শেখে নাই তাহারাই দেশের বাস্তব-সাহিত্য সৃষ্টি করিতেছে, তাহাঁই টিকিবে এবং তাহতেই লোকশিক্ষা হইবে । S S.) t Sbr