পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SQbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তাই যদি হয় তবে আর ভাবনা কিসের । বাস্তব-সাহিত্যের বিপুল ক্ষেত্র ও আয়োজন দেশ জুড়িয়া রহিয়াছে ; তাহার মধ্যে ছিটাফোটা অবাস্তব মুহুর্তকালও টিকিতে পরিবে না । কিন্তু, সেই বৃহৎ বাস্তব-সাহিত্যকে চোখে দেখিলে কাজে লাগিত, একটা আদর্শ পাওয়া যাইত । যতক্ষণ তাহার পরিচয় নাই ততক্ষণ যদি গায়ের জোরে তাহকে মানিয়া লই। তবে সেটা বাস্তবিক হইবে না, কাল্পনিক হইবে । অথচ, এ দিকে ইংরেজি-পোড়োর যে-সাহিত্য সৃষ্টি করিল, রাগিয়া তাহাকে গালি দিলেও, সে বাডিয়া উঠিতেছে ; নিন্দা করিলেও তাহাকে অস্বীকার করিবার জো নাই। ইহাই বাস্তবের প্রকৃত লক্ষণ। এই-যে কোনাে কোনাে মানুষ খামকা রাগিয়া ইহাকে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে তাহারও কারণ, এ স্বপ্ন নয়, এ মায়া নয়, এ বাস্তব । দেখ নাই কি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাগজরা কথায় কথায় বলিয়া থাকে, ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙালি জাতটা গণ্যই নহে ? তাহাদের কথার বঁাজ দেখিলেই বুঝা যায়, তাহারা বাঙালিকেই বিশেষভাবে গণ্য করিয়াছে, কোনোমতেই ভুলিতে পারিতেছে না । ইংরেজি শিক্ষা সোনার কাঠির মতো আমাদের জীবনকে স্পর্শ করিয়াছে ; সে আমাদের ভিতরকার বাস্তবকেই জাগাইল । এই বাস্তবকে যে-লোক ভয় করে, যে-লোক বাধা-নিয়মের শিকলটাকেই শ্রেয় বলিয়া জানে, তাহারা ইংরেজই হউক আর বাঙালিই হউক, এই শিক্ষাকে ভ্ৰম এবং এই জাগরণকে অবাস্তব বলিয়া উড়াইয়া দিবার ভান করিতে থাকে । তাহদের বাধা তর্ক এই যে, এক দেশের আঘাত আর-এক দেশকে সচেতন করে না । কিন্তু, দূর দেশের দক্ষিনে হাওয়ায় দেশান্তরে সাহিত্যকুঞ্জে ফুলের উৎসব জাগাইয়াছে, ইতিহাসে তাহার প্রমাণ আছে । যেখান হইতে যেমন করিয়াই হউক, জীবনের আঘাতে জীবন জাগিয়া উঠে, মানবচিত্ততত্ত্বে ইহা একটি চিরকালের বাস্তব ব্যাপার । কিন্তু, লোকশিক্ষার কী হইবে । সে কথার জবাবদিহি সাহিত্যের নহে । লোক যদি সাহিত্য হইতে শিক্ষা পাইতে চেষ্টা করে তবে পাইতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য লোককে শিক্ষা দিবার জন্য কোনো চিন্তাই করে না । কোনো দেশেই সাহিত্য ইস্কুল-মাস্টারির ভিার লয় নাই । রামায়ণ মহাভারত দেশের সকল লোকে পড়ে তাহার কারণ এ নয় যে, তাহা কৃষাণের ভাষায় লেখা বা তাহাতে দুঃখী-কঙালের ঘরকরনার কথা বর্ণিত । তাহাতে বড়ো বড়ো রাজা, বড়ো বড়ো রাক্ষস, বড়ো বড়ো বীর এবং বড়ো বড়ো বানরের বড়ো বড়ো লেজের কথাই আছে । আগাগোড়া সমস্তই অসাধারণ । সাধারণ লোক আপনার গরজে এই সাহিত্যকে পড়িতে শিখিয়াছে । সাধারণ লোক মেঘদূত, কুমারসম্ভব, শকুন্তলা পড়ে না। খুব সম্ভব দিঙনাগাচার্য এই-কটা বইয়ের মধ্যে বাস্তবের অভাব দেখিয়াছিলেন । মেঘদূতের তো কথাই নাই। কালিদাস স্বয়ং এই বাস্তববাদীদের ভয়ে এক জায়গায় নিতান্ত অকবিজনে৷াচিত কৈফিয়ত দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন- কামার্তা হি প্রকৃতিকৃপণাশ্চেতনাচেতনেষু | আমি অকবিজনে৷াচিত এইজন্য বলিতেছি যে, কবিমাত্রই চেতন-অচেতনের মিল ঘটাইয়া থাকেন, কেননা তাহারা বিশ্বের মিত্র, তাহারা ন্যায়ের অধ্যাপক নহেন। শকুন্তলার চতুর্থ অঙ্ক পড়িলেই সেটা বুঝিতে বাকি থাকিবে না । কিন্তু আমি বলিতেছি, যদি কালিদাসের কাব্য ভালো হয় তবে সমস্ত মানুষের জন্যই তাহা সকল কালের ভাণ্ডারে সঞ্চিত রহিল- আজকের সাধারণ মানুষ যাহা বুঝিল না। কালকের সাধারণ মানুষ হয়তো তাহা বুঝিবে, অন্তত সেইরাপ আশা করি । কিন্তু, কালিদাস যদি কবি না হইয়া লোকহিতৈষী হইতেন তবে সেই পঞ্চম শতাব্দীর উজয়িনীর কৃষাণদের জন্য হয়তো প্ৰাথমিক শিক্ষার উপযোগী কয়েকখানা বই লিখিতেন- তাহা হইলে তার পর হইতে এতগুলা শতাব্দীর কী দশা হইত । তুমি কি মনে কর, লোকহিতৈষী তখন কেহ ছিল না । লোকসাধারণের নৈতিক ও জাঠরিক উন্নতি কী করিয়া হইতে পারে, সে কথা ভাবিয়া কেহ কি তখন কোনো বই লেখে নাই। কিন্তু, সে কি সাহিত্য । ক্লাসের পড়া শেষ হইলেই বৎসর-অন্তর ইস্কুলের বইয়ের যে দশা হয় তাহদেরও সেই দশা