পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ዩ)br রবীন্দ্র-রচনাবলী বড়ো বড়ো পালোয়ানের চেয়ে সে নিৰ্ভয় । অন্তরের আনন্দের মধ্যে সে রয়েছে, সে অমৃত । যখন বাইরে সে নেই তখনো রয়েছে । মৃত্যুর হাতুড়ি পিটিয়েই মহাকালের দরবারে অমৃতের যাচাই হতে থাকে। খ্রিস্টের মৃত্যুসংবাদে এই কথাটাই না খ্রিস্টীয় পুরাণে আছে। মৃত্যুর আঘাতেই তার অমৃতের শিখা উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশ হল না। কি । কিন্তু, একটি কথা মনে রাখতে হবে- আমার কাছে বা তোমার কাছে ঘাড়-নাড়া পাওয়াকেই অমৃতের প্রকাশ বলে না। যেখানে সে রয়ে গেল সেখানে আমাদের দৃষ্টি না যেতেও পারে, আমাদের স্মৃতির পরিমাণে তার অমৃতত্বের পরিমাণ নয়। পূর্ণতার আবির্ভাবকে বুকে করে নিয়ে সে যদি এসে থাকে তা হলে মুহুর্তকালের মধ্যেই সে নিত্যকে দেখিয়ে দিয়েছে- আমার ধারণার উপরে তার আশ্রয় হয়তো এ-সব কথা তত্ত্বজ্ঞানের কোঠায় পড়ে- আমার মতো আনাড়ির পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বজ্ঞানের আলোচনায় অবতীর্ণ হওয়া অসংগত । কিন্তু, আমি সেই শিক্ষকের মঞ্চে দাড়িয়ে কথা বলছি নে । নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় অন্তরে বাহিরে রসের যে-পরিচয় পেয়েছি আমি তারই কাছ থেকে ক্ষণে ক্ষণে আমার প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করেছি । তাই আমি এখানে আহরণ করছি । আমাদের দেশে পরমপুরুষের একটি সংজ্ঞা আছে ; তাকে বলা হয়েছে। সচ্চিদানন্দ । এর মধ্যে আনন্দটিই হচ্ছে সবশেষের কথা, এর পরে আর-কোনো কথা নেই। সেই আনন্দের মধ্যেই যখন প্রকাশের তত্ত্ব তখন এ প্রশ্নের কোনো অর্থই নেই যে, আটের দ্বারা আমাদের কোনো হিতসাধন হয় কি না । বৈশাখ ১৩৩০ তথ্য ও সত্য সাহিত্য বা কলা -রচনায় মানুষের যে-চেষ্টার প্রকাশ, তার সঙ্গে মানুষের খেলা করবার প্রবৃত্তিকে কেউ৯ কেউ এক করে দেখেন । তারা বলেন, খেলার মধ্যে প্রয়োজনসাধনের কোনো কথা নেই, তার উদ্দেশ্য বিশুদ্ধ অবসরবিনোদন ; সাহিত্য ও ললিতকলারও সেই উদ্দেশ্য । এ সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে । আমি কাল বলেছি যে, আমাদের সত্তার একটা দিক হচ্ছে প্ৰাণধারণ, টিকে থাকা । সেজন্যে আমাদের কতকগুলি স্বাভাবিক বেগ আবেগ আছে । সেই তাগিদেই শিশুরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাত পা নাড়ে, আরো একটু বড়ো হলে অকারণে ছুটােছুটি করতে থাকে । জীবনযাত্রায় দেহকে ব্যবহার করবার প্রয়োজনে প্রকৃতি এইরকম অনৰ্থকতার ভান করে আমাদের শিক্ষা দিতে থাকেন। ছোটাে মেয়ে যে-মাতৃভাব নিয়ে জন্মেছে তার পরিচালনার জন্যেই সে পুতুল নিয়ে খেলে। প্ৰাণধারণের ক্ষেত্রে জিগীষাবৃত্তি একটি প্রধান অস্ত্র ; বালকেরা তাই প্রকৃতির প্রেরণায় প্রতিযোগিতার খেলায় সেই বৃত্তিতে শান দিতে থাকে । এইরকম খেলাতে আমাদের বিশেষ আনন্দ আছে ; তার কারণ এই য়ে, প্রয়োজন-সাধনের জন্য আমরা যে-সকল প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মেছি, প্রয়োজনের উপস্থিত দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে নিয়ে তাদের খেলায় প্রকাশ করতে পাই । এই হচ্ছে ফলাসক্তিহীন কর্ম ; এখানে কর্মই চরম লক্ষ্য, খেলাতেই খেলার শেষ । তৎসত্ত্বেও খেলার বৃত্তি আর প্রয়োজনসাধনের বৃত্তি মূলে একই। সেইজন্যে খেলার মধ্যে জীবনযাত্রার নকল এসে পড়ে। কুকুরের জীবনযাত্রায় যে-লড়াইয়ের প্রয়োজন আছে দুই কুকুরের খেলার মধ্যে তারই নকল দেখতে পাই । বিড়ালের খেলা ইদুর-শিকারের নকল । খেলার ক্ষেত্র জীবযাত্রা ক্ষেত্রের প্রতিরূপ ।