পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

868 রবীন্দ্র-রচনাবলী হচ্ছে তার পক্ষপাতধর্ম ; সাহিত্যের বাণী স্বয়ম্বরা । বিজ্ঞানের নির্বিচার কৌতুহল সাহিত্যের সেই বরণ করে নেবার স্বভাবকে পরাস্ত করতে উদ্যত । আজকালকার য়ুরোপীয় সাহিত্যে যৌনমিলনের দৈহিকতা নিয়ে খুব যে একটা উপদ্রব চলছে সেটার প্রধান প্রেরণা বৈজ্ঞানিক কৌতুহল, রেসটােরেশন-যুগে সেটা ছিল। লালসা । কিন্তু, সেই যুগের লালসার উত্তেজনাও যেমন সাহিত্যের রাজটিকা চিরদিনের মতো পায় নি, আজকালকার দিনের বৈজ্ঞানিক কৌতুহলের ঔৎসুক্যও সাহিত্যে চিরকাল টিকতে পারে না । একদিন আমাদের দেশে নাগরিকতা যখন খুব তপ্ত ছিল তখন ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের যথেষ্ট আদর দেখেছি। মদনমোহন তর্কলংকারের মধ্যেও সে বঁাজ ছিল। তখনকার দিনের নাগরিক-সাহিত্যে এ জিনিসটার ছড়াছড়ি দেখা গেছে। যারা এই নেশায় বুদ হয়ে ছিল তারা মনে করতে পারত না যে, সেদিনকার সাহিত্যের রসার্কাঠের এই ধোয়াটাই প্রধান ও স্থায়ী জিনিস নয়, তার আগুনের শিখাটাই আসল । কিন্তু আজ দেখা গেল, সেদিনকার সাহিত্যের গায়ে যে কাদার ছাপ পড়েছিল সেটা তার চামড়ার রঙ নয়, কালস্রোতের ধারায় আজ তার চিহ্ন নেই। মনে তো আছে, যেদিন ঈশ্বরগুপ্ত পাঠার উপর কবিতা লিখেছিলেন সেদিন নূতন ইংরেজরাজের এই হঠাৎ শহর কলকাতার বাবুমহলে কিরকম তার প্রশংসা ধ্বনি উঠেছে। আজকের দিনে পাঠক তাকে কাব্যের পঙক্তিতে স্বভাবতই স্থান দেবে না ; পেটুকতার নীতিবিরুদ্ধ অসংযম বিচার করে নয় ভোজনলালসার চরম মূল্য তার কাছে নেই বলেই। সম্প্রতি আমাদের সাহিত্যে বিদেশের আমদানি যে-একটা বে-আব্রতা এসেছে সেটাকেও এখানকার কেউ কেউ মনে করছেন নিত্যপদার্থ ; ভুলে যান, যা নিত্য তা অতীতকে সম্পূর্ণ প্রতিবাদ করে না । মানুষের রসবোধে যে-আৰু আছে সেইটেই নিত্য ; যে-আভিজাত্য আছে। রসের ক্ষেত্রে সেইটেই নিত্য । এখনকার বিজ্ঞানমদমত্ত ডিমোক্রাসি তাল ঠুকে বলছে, ঐ আৰুটাই দৌর্বল্য, নিবিচার অলজতাই আর্টের : পৌরুষ । এই ল্যাঙট-পরা গুলি-পাকানো ধুলো-মাখা আধুনিকতারই একটা স্বদেশী দৃষ্টান্ত দেখেছি হেলিখেলার দিনে চিৎপুর রোডে । সেই খেলায় আবির নেই, গুলাল নেই, পিচকারি নেই, গান নেই, লম্বা লম্বা ভিজে কাপড়ের টুকরো দিয়ে রাস্তার ধুলোকে পাক ক’রে তুলে তাই চিৎকারশব্দে পরম্পরের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাগলামি করাকেই জনসাধারণ বসন্ত-উৎসব বলে গণ্য করেছে। পরম্পরকে মলিন করাই তার লক্ষ্য, রঙিন করা নয়। মাঝে মাঝে এই অবারিত মালিন্যের উন্মত্ততা মানুষের মনস্তত্ত্বে মেলে না, এমন কথা বলি নে ! অতএব সাইকো-অ্যানালিসিসে এর কার্যকারণ বহু যত্নে বিচাৰ্য । কিন্তু, মানুয্যের রসবোধই যে-উৎসবের মূল প্রেরণা সেখানে যদি সাধারণ মলিনতায় সকল মানুষকে কলঙ্কিত করাকেই আনন্দপ্ৰকাশ বলা হয়, তবে সেই বর্বরতার মনস্তত্ত্বকে এ ক্ষেত্রে অসংগত ব’লেই আপত্তি করব, অসত্য ব’লে নয় । সাহিত্যে রসের হেলিখেলায় কাদা-মাখামাখির পক্ষ সমর্থন উপলক্ষে অনেকে প্রশ্ন করেন, সত্যের মধ্যে এর স্থান নেই কি । এ প্রশ্নটাই অবৈধ । উৎসবের দিনে ভোজপুরীর দল যখন মাতলামির ভূতে-পাওয়া মাদল-করতালের খচোখচোখচকার যোগে একঘেয়ে পদের পুনঃ পুনঃ আবর্তিত গর্জনে পীড়িত সুরলোককে আক্রমণ করতে থাকে, তখন আর্ত ব্যক্তিকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাই অনাবশ্যক যে এটা সত্য কি না, যথার্থ প্রশ্ন হচ্ছে এটা সংগীত কি না । মত্ততার আত্মবিস্মৃতিতে একরকম উল্লাস হয় ; কণ্ঠের অক্লান্ত উত্তেজনায় খুব-একটা জোরও আছে। মাধুর্যহীন সেই রূঢ়তাকেই যদি শক্তির লক্ষণ বলে মানতে হয় তবে এই পালোয়ানির মাতামাতিকে বাহাদুরি দিতে হবে সে কথা স্বীকার করি । কিন্তু, ততঃ কিম !" এ পৌরুষ চিৎপুর রাস্তার, অমরপুরীর সাহিত্যকলার নয় । , উপসংহারে এ কথাও বলা দরকার যে, সম্প্রতি যে-দেশে বিজ্ঞানের অপ্ৰতিহত প্ৰভাবে অলজ কৌতুহল বৃত্তি দুঃশাসনমূর্তি ধরে সাহিত্যলক্ষ্মীর বস্ত্রহরণের অধিকার দাবি করছে, সে-দেশের সাহিত্য অনন্ত বিজ্ঞানের দোহাই পেড়ে এই দীেরাত্ম্যের কৈফিয়ত দিতে পারে । কিন্তু, যে-দেশে অন্তরে-বাহিরে