পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8°8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তরুণীরা ; নাচের নিপুণতা ছিল প্রধান শিক্ষা ; তার সঙ্গে ছিল বীণা বেণু, ছিল গান। মানুষে মানুষে যে-সম্বন্ধ সেটার মধ্যে আত্মিকতার সৌন্দৰ্য ছিল । প্ৰথম বয়সে যে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল তারা বাহিরকে নিজের অন্তরের যোগে দেখছিলেন ; জগৎটা হয়েছিল তাদের নিজের ব্যক্তিগত । আপনি কল্পনা মত ও রুচি সেই বিশ্বকে শুধু যে কেবল মানবিক ও মানসিক করেছিল তা নয়, তাকে করেছিল বিশেষ কবির মনোগত । ওয়ার্ডস্বাথের জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডস্বর্থীয়, শেলির ছিল শেলীয়, বাইরনের ছিল বাইরনিক । রচনার ইন্দ্ৰজালে সেটা পাঠকের ও নিজের হয়ে উঠত । বিশেষ কবির জগতে যেটা আমাদের আনন্দ দিত সেটা বিশেষ ঘরের রসের আতিথ্যে । ফুল তার আপনি, রঙের গন্ধের বৈশিষ্ট্যদ্বারায় মৌমাছিকে নিমন্ত্রণ পাঠায় ; সেই নিমন্ত্রণলিপি মনোহর | কবির নিমন্ত্রণেও স্বভাবতই সেই মনোহারিতা ছিল । যে-যুগে সংসারের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিত্ব-সম্বন্ধটা প্রধান সে-যুগে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণকে সযত্নে জাগিয়ে রাখতে হয় ; সে-যুগে বেশে-ভূষায় শোভনরীতিতে নিজের পরিচয়কে উজ্জ্বল করবার একটা যেন প্ৰতিযোগিতা থাকে । দেখা যাচ্ছে, উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজি কাব্যে পূর্ববর্তীকালের আচারের প্রাধান্য ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দিকে বাক ফিরিয়েছিল। তখনকার কালে সেইটেই হল আধুনিকতা । কিন্তু, আজকের দিনে সেই আধুনিকতাকে মধ্যভিক্টোরীয় প্রাচীনতা সংজ্ঞা দিয়ে তাকে পাশের কামরায় আরাম-কেদারায় শুইয়ে রাখবার ব্যবস্থা করা হয়েছে । এখনকার দিনে ছাটা কাপড় ছাটা চুলের খটখাটে আধুনিকতা । ক্ষণে ক্ষণে গালে পাউডার, ঠোঁটে রঙ লাগানো হয় না তা নয় ; কিন্তু সেটা প্ৰকাশ্যে, উদ্ধত অসংকোচে । বলতে চায় মোহ জিনিসটাতে আর-কোনো দরকার নেই । সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে পদে পদে মোহ ; সেই মোহের বৈচিত্ৰ্যই নানা রূপের মধ্য দিয়ে নানা সুর বাজিয়ে তোলে। কিন্তু, বিজ্ঞান তার নাড়ীনক্ষত্র বিচার করে দেখেছে ; বলছে, মূলে মোহ নেই, আছে কার্বন, আছে নাইট্রোজেন, আছে ফিজিয়লজি, আছে সাইকলজি । আমরা সেকালের কবি, আমরা এইগুলোকেই গীেণ জনতুম, মায়াকেই জানতুম মুখ্য। তাই সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছন্দে বন্ধে ভাষায় ভঙ্গিতে মায়া বিস্তার করে মোহ জন্মাবার চেষ্টা করেছি, এ কথা কবুল করতেই হবে । ঈশারা-ইঙ্গিতে কিছু লুকোচুরি ছিল ; লজার যে আবরণ সত্যের বিরুদ্ধ নয়, সত্যের আভরণ, সেটাকে ত্যাগ করতে পারি নি । তার ঈষৎ বাম্পের ভিতর দিয়ে যে রঙিন আলো এসেছে সেই আলোতে উষা ও সন্ধ্যার একটি রূপ দেখেছি, নববধূর মতো তা সকরুণ । আধুনিক দুঃশাসন জনসভায় বিশ্বদ্রৌপদীর বস্ত্ৰহরণ করতে লেগেছে ; ও দৃশ্যটা আমাদের অভ্যস্ত নয়। সেই অভ্যাসপীড়ার জন্যেই কি সংকোচ লাগে। এই সংকোচের মধ্যে কোনো সত্য কি নেই। সৃষ্টিতে যে-আবরণ প্ৰকাশ করে, আচ্ছন্ন করে না, তাকে ত্যাগ করলে সৌন্দৰ্যকে কি নিঃস্ব হতে হয় না । কিন্তু, আধুনিক কালের মনের মধ্যেও তাড়াহুড়ো, সময়েরও অভাব । জীবিকা জিনিসটা জীবনের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। তাড়া-লাগানো যন্ত্রের ভিড়ের মধ্যেই মানুষের হু হু করে কাজ, হুড়মুড় করে আমোদ-প্ৰমোদ । যে-মানুষ একদিন রয়ে-বসে আপনার সংসারকে আপনার করে সৃষ্টি করত। সে আজ কারখানার উপর বরাত দিয়ে প্রয়োজনের মাপে তড়িঘড়ি একটা সরকারি আদর্শে কাজ-চালানো কাণ্ড খাড়া করে তোলে । ভোজ উঠে গেছে, ভোজনটা বাকি । মনের সঙ্গে মিল হল কি না সে কথা ভাববার তাগিদ নেই, কেননা মন আছে অতি প্ৰকাণ্ড জীবিকা-জগন্নাথের রথের দড়ি ভিড়ের লোকের সঙ্গে মিলে টানবার দিকে । সংগীতের বদলে তার কষ্ঠে শোনা যায়, "মারো ঠেলা হেঁইয়ো।’ জনতার জগতেই তাকে বেশির ভাগ সময় কাটাতে হয়, আত্মীয়সম্বন্ধের জগতে নয়। তার চিত্তবৃত্তিটা মাটিশের চিত্তবৃত্তি। হােড়াছড়ির মধ্যে জগজিত কুৎসিডকে পাশ কাটিয়ে সবার প্রতি তার কাব্য তা হলে আজ কোন লক্ষ্য ধরে কোন রান্তায় বেরোবে। নিজের মনের মতো করে পছন্দ করা, বাছাই করা, সাজাই করা, এ এখন আর চলবে না। বিজ্ঞান বাছাই করে না, যা-কিছু আছে তাকে