পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8br> প্ৰবেশ করতে সজনে ফুলের বিলম্ব হয়েছে এই কারণেই, তাকে জানি ভোজ্য বলে একটা সাধারণ ভাবে । চালতা-ফুল এখনো কাব্যের দ্বারের কাছেও এসে পৌঁছয় নি। জামরুলের ফুল শিরীষ ফুলের চেয়ে অযোগ্য নয় ; কিন্তু তার দিকে যখন দৃষ্টিপাত করি তখন সে আপন চরমরূপে প্রকাশ পায় না, তার পরপর্যায়ের খাদ্য ফলেরই পূর্বপরিচয় রূপে তাকে দেখি । তার নিজেরই বিশিষ্টতার ঘোষণা যদি তার মধ্যে মুখ্য হত তা হলে সে এতদিনে কাব্যে আদর পেত। মুরগি পাখির সৌন্দর্য বঙ্গসাহিত্যে কেন যে অস্বীকৃত, সে কথা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে। আমাদের চিত্ত এদেরকে নিজেরই স্বরূপে দেখে না, অন্য-কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে তার দ্বারা আবৃত ক’রে দেখে । ধারা আমার কবিতা পড়েছেন তাদের কাছে পুনরুক্তি হলেও একটা খবর এখানে বলা চলে । ছিলেম মফস্বলে, সেখানে আমার এক চাকর ছিল তার বুদ্ধি বা চেহারা লক্ষ্য করবার যোগ্য ছিল না । রাত্রে বাড়ি চলে যায়, সকালে এসে ঝাড়ন কাধে কাজকর্ম করে । তার প্রধান গুণ, সে কথা বেশি বলে না । সে যে আছে সে তথ্যটা অনুভব করলুম। যেদিন সে হল অনুপস্থিত । সকালে দেখি, মানের জল তোলা হয় নি, ঝাড়পোছ বন্ধ । এল বেলা দশটার কাছাকাছি । বেশ একটু রূঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করলুম, “কোথায় ছিলি ।” সে বললে, “আমার মেয়েটি মারা গেছে কাল রাতে ৷” ব’লেই ঝাড়ন নিয়ে নিঃশব্দে কাজে লেগে গেল। বুকটা ধক ক’রে উঠল। ভূত্যরূপে যে ছিল প্রয়োজনীয়তার আবরণে ঢাকা, তার আবরণ উঠে গেল ; মেয়ের বাপ বলে তাকে দেখলুম, আমার সঙ্গে তার স্বরূপের মিল হয়ে গেল ; সে হল প্ৰত্যক্ষ, সে হল বিশেষ । সুন্দরের হাতে বিধাতার পাসপোর্ট আছে ; সর্বত্রই তার প্রবেশ সহজ । কিন্তু, এই মোমিন মিঞা, একে কী বলব । সুন্দর বলা তো চলে না । মেয়ের বাপিও তো সংসারে অসংখ্য ; সেই সাধারণ তথ্যটা সুন্দরও না, অসুন্দরও না । কিন্তু, সেদিন করুণরসের ইঙ্গিতে গ্রাম্য মানুষটা আমার মনের মানুষের সঙ্গে মিলল ; প্রয়োজনের বেড়া অতিক্রম ক'রে কল্পনার ভূমিকায় মোমিন মিঞা আমার কাছে হল বাস্তব । লক্ষপতির ঘরে মেজো মেয়ের বিবাহ। এমন ধুম পাড়ার অতিবৃদ্ধেরও বলে অভূতপূর্ব। তার ঘোষণার তরঙ্গ খবরের কাগজের সংবাদবীথিকায় উদবোল হয়ে উঠেছে। জনশ্রুতির কোলাহলে ঘটনাটা যতই গুরুতর প্রতিভাত হােক, তবু এই বহুব্যয়সাধ্য বিপুল সমারোহেও ব্যাপারটাকে ‘মেয়ের বিয়ে নামক সংবাদের নিতান্ত সাধারণত থেকে উপরে তুলতে পারে না । সাময়িক উন্মুখরতার জোরে এ স্মরণীয় হয়ে ওঠে না । কিন্তু, ‘কন্যার বিবাহ’ নামক অত্যন্ত সাধারণ ঘটনাকে তার সাময়িক ও স্থানিক আত্মপ্রচারের আশুমানতা থেকে যদি কোনো কবি তার ভাষায় ছন্দে দীপ্তিমান সাহিত্যের সামগ্ৰী করে তোলেন, তা হলে প্ৰতিদিনের হাজার-লক্ষ মেয়ের বিবাহের কুহেলিকা ভেদ করে এ দেখা দেবে একটি অদ্বিতীয় মেয়ের বিবাহরূপে, যেমন বিবাহ কুমারসম্ভবের উমার, যেমন বিবাহ রঘুবংশের ইন্দুমতীর । সাংকোপাঞ্জা ডানকুইকসোটের ভূত্যমাত্র, সংসারের প্রবহমান তথ্যপুঞ্জের মধ্যে তাকে তৰ্জমা করে দিলে সে চোখেই পড়বে না- তখন হাজার-লক্ষ চাকরের সাধারণ-শ্রেণীর মাঝখানে তাকে সনাক্ত করবে কে । ডানকুইকসোটের চাকর আজ চিরকালের মানুষের কাছে চিরকালের চেনা হয়ে আছে, সবাইকে দিচ্ছে তার একান্ত প্রত্যক্ষতার আনন্দ ; এ পর্যন্ত ভারতের যতগুলি বড়েলাট হয়েছে তাদের সকলের জীবনবৃত্তান্ত মেলালেও এই চাকরীটির পাশে তারা নিম্প্রভ । বড়ো বড়ো বুদ্ধিমান রাজনীতিকের দল মিলে অস্ত্ৰলাঘব ব্যাপার নিয়ে যে বাদবিতণ্ডা তুলেছেন তথ্যহিসাবে সে একটা মস্ত তথ্য ; কিন্তু যুদ্ধে-পঙ্গু একটি মাত্র সৈনিকের জীবন যে-বেদনায় জড়িত তাকে সুস্পষ্ট প্ৰকাশমান করতে পারলে সকল কালের মানুষ রাষ্ট্রনীতিকের গুরুতর মন্ত্রণা-ব্যাপারের চেয়ে তাকে প্রধান স্থান দেবে। এ কথা নিশ্চিত জানি, যে-সময়ে শকুন্তলা রচিত হয়েছিল তখন রাষ্টিক আর্থিক অনেক সমস্যা উঠেছিল যার গুরুত্ব তখনকার দিনে অতি প্ৰকাণ্ড উদবোগরূপে ছিল ; কিন্তু সে-সমস্তের আজ চিহ্নমাত্র নেই, আছে শকুন্তলা । মানবের সামাজিক জগৎ দুলোকের ছায়াপথের মতো । তার অনেকখানিই নানাবিধ অবিচ্ছিন্ন তত্ত্বের অর্থাৎ অ্যাবস্ট্রাকশনের বহুবিস্তৃত নীহারিকায় অবকীর্ণ ; তাদের নাম হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, নেশন,