পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(OO রবীন্দ্র-রচনাবলী পাঁচটি বিভিন্ন ফুলকে কুটে দিলা পাকালেই তাকে শতদল বলা যেতে পারে না। অরণ্যের বিভিন্ন পত্রপুষ্পের মধ্যে যে-ঐক্য আছে তা হল বসন্তের ঐক্য । কারণ, বসন্তসমাগমে ফায়ুনের সমীরণে তাদের সকলেরই মঞ্জরী মুকুলিত হয়ে ওঠে। তাদের বৈচিত্র্যের অন্তরালে যে বসন্তের একই বাণীর চলাচলের পথ, সেখানেই তারা এক ও মিলিত । রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে জবরদস্ত লোকেরা বলে থাকে যে, মানুষকে বড়োরকমের বাধনে বেঁধেছেদে মেরেকেটেকুটে প্রয়োজন সাধন করতে হবে- এমন দাঁড়াদড়ি দিয়ে বাধলেই নাকি ঐক্য সাধিত হতে পারে। অদ্বৈতের মধ্যে যে পরমমুক্ত শিব রয়েছেন তাকে তারা চায় না । তারা বেঁধেছেদে দ্বৈতকে বস্তাবন্দী করে যে অদ্বৈতের ভান তাকেই মেনে থাকে । কিন্তু র্যারা যথার্থ অদ্বৈতকে অন্তরে লাভ করেছেন তারা তো তাকে বাইরে খোজেন না । বাইরের যে-এক তা হচ্ছে প্ৰলয়, তাই একাকারত্ব ; আর অন্তরের যে-এক তা হল সৃষ্টি, তাই ঐক্য । একটা হল পঞ্চােত্ব, আর-একটা হল পঞ্চায়েৎ | আজকার এই সাহিত্যসম্মিলনে বাংলাদেশের প্রতিবেশী অনেক বন্ধুও সমাগত হয়েছেন । তারা যদি এই সম্মিলনে সমাগত হয়ে নিমন্ত্রণের গৌরবলাভে মনের মধ্যে কোনো বাধাবোধ না করে থাকেন তবে তাতে অনেক কাজ হয়েছে । আমরা যেন বাঙালির স্বাজাত্য-অভিমানের অতিমাত্রায় মিলনযজ্ঞে বিয় না বাধাই । দক্ষ তো আপন আভিজাত্যের অভিমানেই শিবকে রাগিয়ে দিয়েছিলেন । যে-দেশে হিন্দি ভাষার প্রচলন সে-দেশে প্রবাসী বাঙালি বাংলাভাষায় ক্ষেত্র তৈরি করেছে, এতে বাঙালিদের এই প্ৰতিষ্ঠানের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে । এই উত্তরভারতে কাশীতে র্তারা কী পেলেন, বাস করি তারা এখানকার এ-সবের সঙ্গে পরিচিত নই ; উত্তরভারতের লোককে আমরা মানচিত্র বা গেজেটিয়ারের সহযোগে দেখেছি । বাঙালি যখন আপন ভাষার মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে পরিচয় বিস্তার করে সৌহার্দ্যের পথ মুক্ত করবেন তাতে কল্যাণ হবে । ভালোবাসার সাধনার একটা প্রধান সোপান शश्र् अ3 °६ ।। পরস্পরের পরিচয়ের অভাবই মানুষের প্রভেদকে বড়ো করে তোলে। যখন অন্তরের পরিচয় না। হয় তখন বাইরের অনৈক্যই চোখে পড়ে, আর তাতে পদে পদে অবজ্ঞার সঞ্চার হয়ে থাকে । আজ বাংলাভাষাকে অবলম্বন করে উত্তরভারতের সঙ্গে সেই আন্তরিক পরিচয়ের প্রবাহ বাংলার অভিমুখে ধাবিত হােক । এখানকার সাহিত্যিকেরা আধুনিক ও প্রাচীন উত্তরভারতীয় সাহিত্যের যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা সকলের শ্রদ্ধা উৎপাদন করবার যোগ্য, তা সংগ্রহ করে দূরে বাংলাদেশে পাঠাবেন- এমনিভাবে ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলার সঙ্গে উত্তরভারতের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হবে । আমি হিন্দি জানি না, কিন্তু আমাদের আশ্রমের একটি বন্ধুর কাছ থেকে প্রথমে আমি প্রাচীন হিন্দি সাহিত্যের আশ্চর্য রত্নসমূহের কিছু কিছু পরিচয় লাভ করেছি। প্রাচীন হিন্দি কবিদের এমন-সকল গান তার কাছে শুনেছি যা শুনে মনে হয় সেগুলি যেন আধুনিক যুগের । তার মানে হচ্ছে, যে-কাব্য সত্য তা চিরকালই আধুনিক । আমি বুঝলুম, যে-হিন্দিভাষার ক্ষেত্রে ভাবের এমন সোনার ফসল ফলেছে। সে-ভাষা যদি কিছুদিন আকৃষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। তবু তার স্বাভাবিক উর্বরতা মরতে পারে না ; সেখানে আবার চাষের সুদিন আসবে এবং পৌষমাসে নবান্ন-উৎসব ঘটবে। এমনি করে এক সময় আমার বন্ধুর সাহায্যে এ দেশের ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আমার শ্রদ্ধার যোগ স্থাপিত হয়েছিল । উত্তর-পশ্চিমের সঙ্গে সেই শ্রদ্ধার সম্বন্ধটি যেন আমাদের সাধনার বিষয় হয় । মা বিদ্বিষাবহৈ । আজ বসন্তসমাগমে অরণ্যের পাতায় পাতায় পুলকের সঞ্চার হয়েছে। গাছের যা শুকনো পাতা ছিল তা ঝরে গেল । এমন দিনে যারা হিসাবের নীরস পাতা উলটাতে ব্যস্ত আছে তারা এই দেশব্যাপী বসন্ত-উৎসবের ছন্দে যোগ দিতে পারল না । তারা পিছনে পড়ে রইল । দেশে আজ যে পোলিটিকাল উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছে তার যতই মূল্য থােক, “এহ বাহ্য' । এর সমস্ত লাভ-লোকসানের হিসাবের চেয়ে অনেক বড়ো কথা রয়ে গেছে সেই সুগভীর আত্মিক-প্রেরণার মধ্যে যার প্রভাবে এই বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের এমন স্বচ্ছন্দবিকাশ হয়েছে। স্বাস্থ্যের যে স্বাভাবিক প্ৰাণগত ক্রিয়া আছে, তা অগোচরে