পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে GłR\O হিতের প্রতি লক্ষ করে লেখকেরা কঠিন কথা বলেন তার দাম কমে যায় । মনে হয়, কঠিন কথা বলাতেই লেখকের বিশেষ আনন্দ, তার লক্ষ্য যেই হােক আর যাই হােক । কর্তব্যপালনের যে অবশ্যম্ভাবী কঠোরতা আছে নিজেরও সম্বন্ধে সেটাকে অত্যন্ত দৃঢ় রাখা চাই । “শনিবারের চিঠি’র লেখকদের সুতীক্ষ লেখনী, তাদের রচনানৈপুণ্যেরও আমি প্রশংসা করি, কিন্তু এই কারণেই তাদের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি ; তাদের খড়েগির প্রখরতা প্ৰমাণ করবার উপলক্ষে অনাবশ্যক হিংস্ৰতা লেশমাত্ৰ প্ৰকাশ না পেলে তবেই তাদের শৌর্যের প্রমাণ হবে । সাহিত্যসংস্কার কার্যে তাদের কর্তব্যের ক্ষেত্ৰ আছে- কিন্তু কর্তব্যটি অপ্ৰিয় বলেই এই ক্ষেত্রে সীমা তাদেরকে একান্তভাবে রক্ষা করতে হবে । অস্ত্ৰচিকিৎসায় অস্ত্ৰচালনার সতর্কতা অত্যন্ত বেশি দরকার, কেননা আরোগ্যবিধানই এর লক্ষ্য, মারা এর লক্ষ্য নয় । সাহিত্যের চিকিৎসাই “শনিবারের চিঠি’র লক্ষ্য, এই কারণেই এই লক্ষ্যের একটুমাত্র বাইরে গেলেও তাদের প্রতিপত্তি নষ্ট হবে । চিকিৎসকের পক্ষে অস্ত্ৰচালনার কৌশলই একমাত্র জিনিস নয়। প্রতিপত্তিও মহামূল্য । সেই প্রতিপত্তি রক্ষা করে “শনিবারের চিঠি” যদি কর্তব্যের খাতিরে নিষ্ঠুরও হন। তাকে কেউ নিন্দা করতে পারবে না। র্যাদের শক্তি আছে তাদের কাছেই আমরা যথাস্থানে ক্ষান্তি দাবি করি । কর্তব্য যেখানে বড়ো সেখানেই তার পদ্ধতি সম্বন্ধে বিশেষ শুচি রক্ষার �0:୫୪tion || আধুনিক সাহিত্যের doctrine সম্বন্ধে পুনরায় কেবলমাত্র না-মানার দ্বারা সাহিত্যিক হওয়া যায় না। শুধু ভগবান প্রেম আর ভূত কেন তোমরা আরো অনেক কিছু না মানতে পার । যেমন, হােমিওপ্যাথি চিকিৎসা । কিন্তু, এই প্রসঙ্গে যদি সে কথাও লিখতে তা হলে বুঝতেম সেটাতে সাহিত্য-বহির্বতী বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে। সাহিত্য-আলোচনায় যদি বল, অনেকে বলে ভীমনাগের সন্দেশ ভালো, আমি বলি ভালো নয়, তার দ্বারা সাহিত্যিক সাহিসিকতা বা অপূর্বতার প্রমাণ হয় না। সর্বশেষে অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে কেউ লিখতে পারে না । তোমরা বলতে পাের, দরিদ্রের মনোবৃত্তি আমি বুঝি না, এ কথা মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। তোমরা যদি বল, তোমাদের সাহিত্যের বিশেষত্ব দারিদ্র্যের অনুভূতি, আমি বলব সেটা গৌণ । তোমরা যদি সর্বদা বাস্পরুদ্ধ কষ্ঠে দরিদ্রনারায়ণ “দরিদ্রনারায়ণ” করা তাতে ক’রে এমন একটা বায়ুবৃদ্ধি হবে যাতে সাধারণ পাঠকেরা দরিদ্রনারায়ণ বললেই চোখের জলে ভেসে যাবে । তোমরা কথায় কথায় আধুনিক মাসিকপত্রে বল, আমরা আধুনিক কালের লোক, অতএব গরিবের জন্যে কাদব । এরকম ভঙ্গিমা বিস্তারের প্রশ্রয় সাহিত্যে অপকার করে । আমরা অর্থশাস্ত্ৰ শেখবার জন্য গল্প পড়ি না । গল্পের জন্য গল্প পড়ি । “গরিবিয়ানা “দরিদ্রিয়ানা’কে সাহিত্যের অলংকার করে তুলো না । ভঙ্গি মাত্রেরই অসুবিধা এই যে, অতি সহজেই তার অনুকরণ করা যায়- অল্পবুদ্ধি লেখকের সেটা আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে । যখন তোমাদের লেখা পড়বে তখন এই বলে পড়ব না যে, এইবার গরিবের কথা পড়া যাক । গোড়ার থেকে ছাপ মেরে চিহ্নিত করে তোমরা নিজেদের দাম কমিয়ে দাও । দল বেঁধে সাহিত্য হয় না । সাহিত্য হচ্ছে একমাত্র সৃষ্টি যা মানুষ একলাই করেছে। যখন সেটা দল বাধার কোঠায় গিয়ে পড়ে তখন সেটা আর সাহিত্য থাকে না । প্রত্যেকের নিজের ভিতর অভিমান থাকা উচিত যে, আমি যা লিখছি ‘গরিবিয়ানা’ বা “যুগ প্রচার করবার জন্য নয়, একমাত্র আমি যেটা বলতে পারি সেটাই আমি লিখছি। এ কথা বললেই লেখক যথার্থ সাহিত্যিকের আসন পায় । উপসংহারে এ কথাও আমি বলে রাখতে চাই, তোমাদের অনেক লেখকের মধ্যে আমি প্রতিভার লক্ষণ দেখেছি। আমি কামনা করি, তারা যুগ-প্রবর্তনের লোভে পড়ে তাদের লেখার সর্বাঙ্গে কোনো দলের ছাপের উলকি পরিয়ে তাকে সজিত করা হল বলে না মনে করেন । তাদের শক্তির বিশুদ্ধ স্বকীয় রূপটি জগতে জয়ী হোক । জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫ Y Sq lVO8