পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

<svg 企8> পাশ্চাত্যেরই সংঘাতে সংস্রবে। জাপান অতি অল্পকালের মধ্যেই বিশ্বজাতিসংঘের মধ্যে জয় করে নিলে সম্মানের অধিকার । অর্থাৎ জাপান বর্তমান কালের মধ্যেই বর্তমান, অতীতে ছায়াচ্ছন্ন নয়, সে তা সম্যকরূপে প্ৰমাণ করল । দেখতে পেলেম প্ৰাচ্য জাতিরা নবযুগের দিকে যাত্রা করেছে। অনেকদিন আশা করেছিলুম, বিশ্ব-ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের সামঞ্জস্য হবে, আমাদেরও রাষ্ট্রজাতির রথ চলবে সামনের দিকে, এবং এও মনে ছিল যে, এই চলার পথে টান দেবে স্বয়ং ইংরেজও । অনেকদিন তাকিয়ে থেকে অবশেষে দেখলুম। চাকা বন্ধ । আজ ইংরেজ-শাসনের প্রধান গর্ব 'ল' এবং 'অর্ডার', বিধি এবং ব্যবস্থা নিয়ে । এই সুবৃহৎ দেশে শিক্ষার বিধান, স্বাস্থ্যের বিধান অতি অকিঞ্চিৎকর, দেশের লোকের দ্বারা নব নব পথে ধন-উৎপাদনের সুযোগ-সাধন কিছুই নেই। অদূর ভবিষ্যতে তার যে সম্ভাবনা আছে, তাও দেখতে পাই নে, কেননা দেশের সম্বল সমস্তই তলিয়ে গেল 'ল' এবং 'অর্ডরের প্ৰকাণ্ড কবলের মধ্যে । যুরোপীয় নব-যুগের শ্রেষ্ঠদানের থেকে ভারতবর্ষ বঞ্চিত হয়েছে য়ুরোপেরই সংস্রবে । নবযুগের সূর্য-মণ্ডলের মধ্যে কলঙ্কের মতো রয়ে গেল ভারতবর্ষ। আজ ইংলন্ড ফ্রান্স জার্মানি আমেরিকার কাছে ঋণী। ঋণের অঙ্ক খুব মোটা । কিন্তু এর দ্বিগুণ মোটাও যদি হত, তবু সম্পূৰ্ণ শোধ করা অসাধ্য হত না, দেনাদার দেশে যদি কেবলমাত্র “ল এবং ‘অর্ডার’ বজায় রেখে তাকে আর-সকল বিষয়ে বঞ্চিত রাখতে আপত্তি না থাকত । যদি তার অন্নসংস্থান রইত আধাপেটা-পরিমাণ, তার পানযোগ্য। জলের বরাদ্দ হত সমস্ত দেশের তৃষ্ণার চেয়ে বহুগুণ স্বল্পতর, যদি দেশে শতকরা পাচ-সাত জন মানুষের মতো শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও চলত, যদি চিরস্থায়ী রোগে প্রজনানুক্রমে দেশের হাড়ে হাড়ে দুর্বলতা নিহিত করে দেওয়া সত্ত্বেও নিশ্চেষ্টপ্রায় থাকত। তার আরোগ্যবিধান । কিন্তু যেহেতু জীবনযাত্রার সভ্য আদর্শ বজায় রাখবার পক্ষে এ-সকল অভাব একেবারেই মারাত্মক, এইজন্যে পাওনাদারকে এমন কথা বলতে শুনলুম যে আমরা দেনাশোধ করব না । সভ্যতার দোহাই দিয়ে ভারতবর্ষ কি এমন কথা বলতে পারে না যে, এই প্ৰাণ-দেউলে—করা তোমাদের দুর্মুল্য শাসনতন্ত্রের এত অসহ্য দেনা আমরা বহন করতে পারব না যাতে বর্বরাদশার জগদ্দল পাথর চিরদিনের মতো দেশের বুকের উপর চেপে থাকে। বর্তমান যুগে য়ুরোপ যে-সভ্যতার আদর্শকে উদভাবিত করেছে। য়ুরোপই কি স্বহস্তে তার দাবিকে ভূমণ্ডলের পশ্চিম সীমানাতেই আবদ্ধ করে রাখবে। সর্বজনের সর্বকালের কাছে সেই সভ্যতার মহৎ দায়িত্ব কি য়ুরোপের নেই। ক্ৰমে ক্ৰমে দেখা গেল। য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয়মণ্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্যে নয়, আগুন লাগাবার জন্যে । তাই একদিন কামানের গোলা আর আফিমের পিণ্ড একসঙ্গে বর্ষিত হল চীনের মর্মস্থানের উপর। ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন সর্বনাশ আর কোনোদিন কোথাও হয় নি- এক হয়েছিল য়ুরোপীয় সভ্যজাতি যখন নবাবিকৃত আমেরিকায় স্বর্ণপণ্ডের লোভে ছলে বলে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দিয়েছে “মায়া জাতির অপূর্ব সভ্যতাকে । মধ্যযুগে অসভ্য তাতার বিজিত দেশে নরমুণ্ডের তৃপি উচু করে তুলেছিল ; তার বেদনা অনতিকাল পরে লুপ্ত হয়েছে। সভ্য য়ুরোপ চীনের মতো এত বড়ো দেশকে জোর করে যে বিষ গিলিয়েছে, তাতে চিরকালের মতো তার মজা জর্জরিত হয়ে গেল । একদিন তরুণ পারসিকের দল দীর্ঘকালের অসাড়তার জাল থেকে পারস্যকে উদ্ধার করবার জন্যে যখন প্রাণপণ করে দাড়িয়েছিল, তখন সভ্য য়ুরোপ কী রকম করে দুই হাতে তার টুটি চেপে ধরেছিল, সেই অমার্জনীয় শোকাবহ ব্যাপার জানা যায় পারস্যের তদানীন্তন পরাহত আমেরিকান রাজস্ব সচিব শুস্টারের Strangling of Persia বইখানা পড়লে । ও দিকে আফ্রিকার কনগো প্রদেশে যুরোপীয় শাসন যে কী রকম অকথ্য বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল। সে সকলেরই জানা । আজও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে নিগ্ৰেজাতি সমাজিক অসম্মানে লাঞ্ছিত, এবং সেই-জাতীয় কোনো হতভাগ্যকে যখন জীবিত অবস্থায় দাহ করা হয়, তখন শ্বেতচমী নরনারীরা সেই পাশব দৃশ্য উপভোগ করবার জন্যে ভিড় করে আসে । তার পরে মহাযুদ্ধ এসে অকস্মাৎ পাশ্চাত্য ইতিহাসের একটা পর্দা তুলে দিলে। যেন, কোন মাতালের আৰু গেল ঘুচে । এত মিথ্যা বীভৎস হিংস্রতা নিবিড় হয়ে বহু পূর্বকার অন্ধ যুগে ক্ষণকালের