পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(GO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সেখানকার রাষ্ট্ৰীয় বঙ্গভূমিতে প্রধান নায়কের সাজে দেখা দিয়াছে। আমরা দর্শকরূপে এত দূরে আছি যে, আমরা তাহার হাত-পা নাড়া যতটা দেখি তাহার বাণীটা সে পরিমাণে শুনিতে পাই না । এইজন্যই নকল করিবার সময় ঐ অঙ্গভঙ্গিটাই আমাদের একমাত্র সম্বল হইয়া উঠে । কিন্তু সেখানে কাণ্ডটা কী হইতেছে সেটা জানা চাই । য়ুরোপে যাহারা একদিন বিশিষ্টসাধারণ বলিয়া গণ্য হইত। তাহারা সেখানকার ক্ষত্রিয় ছিল। তখন কাটাকাটি মারামারির অন্ত ছিল না। তখন য়ুরোপের প্রবল বহিঃশত্রু ছিল মুসলমান ; আর ভিতরে ছোটাে ছোটাে রাজ্যগুলা পরস্পরের গায়ের উপর পড়িয়া কেবলই মাথা ঠোকাঠুকি করিত । তখন দুঃসাহসিকের দল চারি দিকে আপনার ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া বেড়াইত— কোথাও শান্তি ছিল না। সে সময়ে সেখানকার ক্ষত্ৰিয়েরাই ছিল দেশের রক্ষক । তখন তাহদের প্রাধান্য স্বাভাবিক ছিল । তখন লোকসাধারণের সঙ্গে তাহদের যে সম্বন্ধ ছিল সেটা কৃত্রিম নহে। তাহারা ছিল রক্ষাকর্তা এবং শাসনকর্তা । লোকসাধারণে তাহাদিগকে স্বভাবতই আপনাদের উপরিবতী বলিয়া মানিয়া লইত । তাহার পরে ক্রমে অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। এখন যুরোপে রাজার জায়গািট রাষ্ট্রতন্ত্র দখল করিতেছে, এখন লড়াইয়ের চেয়ে নীতিকৌশল প্রধান হইয়া উঠিয়াছে। যুদ্ধের আয়োজন পূর্বের চেয়ে বাড়িয়াছে বৈ-কমে নাই। কিন্তু এখন যোদ্ধার চেয়ে যুদ্ধবিদ্যা বড়ো ; এখন বীর্যের আসনে বিজ্ঞানের অভিষেক হইয়াছে। কাজেই য়ুরোপে সাবেককালের ক্ষত্ৰিয়বংশীয়েরা এবং সেই সকল ক্ষত্ৰিয়-উপাধিধারীরা যদিও এখনো আপনাদের আভিজাত্যের গৌরব করিয়া থাকে। তবু লোকসাধারণের সঙ্গে তাহাদের স্বাভাবিক সম্বন্ধ ঘুচিয়া গেছে। তাই রাষ্ট্রচালনার কাজে তাহাদের আধিপত্য কমিয়া আসিলেও সেটাকে জাগাইয়া তুলিবার জোর তাহাদের নাই। শক্তির ধারাটা এখন ক্ষত্রিয়কে ছাড়িয়া বৈশ্যের কুলে বহিতেছে। লোকসাধারণের কাধের উপরে তাহারা চাপিয়া বসিয়াছে। মানুষকে লইয়া তাহারা আপনার ব্যবসায়ের যন্ত্র বানাইতেছে। মানুষের পেটের জ্বালাই তাহদের কলের স্টীম উৎপন্ন করে । পূর্বকালের ক্ষত্রিয়নায়কের সঙ্গে মানুষের যে-সম্বন্ধ ছিল সেটা ছিল মানবসম্বন্ধ। দুঃখ কষ্ট অত্যাচার যতই থােক, তবু পরস্পরের মধ্যে হৃদয়ের আদানপ্রদানের পথ ছিল । এখন বৈশ্য মহাজনদের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ যান্ত্রিক । কর্মপ্ৰণালী-নামক প্ৰকাণ্ড একটা জাতা মানুষের আর-সমস্তই গুড়া করিয়া দিয়া কেবল মজুরটুকু মাত্র বাকি রাখিবার চেষ্টা করিতেছে। ধনের ধর্মই অসাম্য । জ্ঞান ধর্ম কলাসৌন্দর্য পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করিলে বাড়ে বৈ কমে না, কিন্তু ধন জিনিসটাকে পাচজনের কাছ হইতে শোষণ করিয়া লইয়া পাচজনের হাত হইতে তাহাকে রক্ষা না করিলে সে টেকে না । এইজন্য ধনকামী নিজের গরজে দারিদ্র্য সৃষ্টি করিয়া থাকে। তাই ধনের বৈষম্য লইয়া যখন সমাজে পার্থক্য ঘটে তখন ধনীর দল সেই পার্থক্যকে সমূলে ঘুচাইতে ইচ্ছা করে না, অথচ সেই পার্থক্যটা যখন বিপদজনক হইয়া উঠে তখন বিপদটাকে কোনোমতে ঠেকো দিয়া ঠেকাইয়া রাখিতে চায় । তাই ও দেশে শ্রমজীবীর দল যতই শুমারিয়া গুমরিয়া উঠিতেছে ততই তাহাদিগকে ক্ষুধার অন্ন না দিয়া ঘুম-পাড়াইবার গান গাওয়া হইতেছে ; তাহাদিগকে অল্পস্বল্প এটা-ওটা দিয়া কোনােমতে ভুলইয়া রাখিবার চেষ্টা । কেহ বলে উহাদের বাসা একটু ভালো করিয়া দাও, কেহ বলে যাহাতে উহারা দু চামচ সুপি খাইয়া কাজে যাইতে পারে অহার বন্দোবন্ত করো, কেহ বা তাহাদের বাড়িতে গিয়া মিষ্টমুখে কুশল জিজ্ঞাসা করে, শীতের দিনে কেহ বা আপন উদ্যবৃত্ত গরম কাপড়টা তাহাদিগকে পাঠাইয়া দেয় । এমনি করিয়া ধনের প্রকাণ্ড জালের মধ্যে আটকা পড়িয়া লোকসাধারণ ছটফট করিয়া উঠিয়াছে। ধনের চাপটা যদি এত জোরের সঙ্গে তাহদের উপর না পড়িত। তবে তাহারা জমাট বাধিত না- এবং তাহারা-যে কেহ বা কিছু তাহা কাহারও খবরে আসিত না । এখন ও দেশে লোকসাধারণ কেবল সেন্সাস-রিপোর্টের তালিকাভুক্ত নহে; সে একটা শক্তি। সে আর ভিক্ষা করে না, দাবি করে। এইজন্য তাহার কথা দেশের লোকে আর ভুলিতে পারিতেছে না ; সকলকে সে বিষম ভাবাইয়া তুলিয়াছে।