পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(We NR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কাঠ আছে সেটা স্বাধীনশাসনের অন্ত্যেষ্টিসৎকারের কাজে লাগিতে পারে । তার পরে লোনা জলে পেট ভরাইয়া ডাঙায় উঠিতে পারিলেই আমাদের অদৃষ্টের কাছে কৃতজ্ঞ থাকিব । দেখিতে পাই, বড়ো-ইংরেজের দাক্ষিণ্যকেই চরম সম্পদ গণ্য করিয়া আমাদের লোকে চড়া চড়া কথায় ছোটাে-ইংরেজের মুখের উপর জবাব দিতে শুরু করিয়াছেন। ছোটাে-ইংরেজের জোর যে কতটা খেয়াল করিতেছেন না । ভুলিয়াছেন, মাঝখানের পুরোহিতের মামুলি বরাদের পাওনা উপরের দেবতার বরকে বিকাইয়া দিতে পারে । এই মধ্যবতীর জোর কতটা এবং ইহাদের মেজাজটা কী ধরনের সে কি বারে বারে দেখি নাই । ছোটো-ইংরেজের জোর কত সেটা যে কেবল আমরা লর্ড রিপনের এবং কিছু পরিমাণে লর্ড হার্ডিঞ্জের আমলে দেখিলাম তাহা নহে, আর-একদিন লর্ড ক্যানিং এবং লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলেও দেখা গেছে । তাই দেশের লোককে বার বার বলি, “কিসের জোরে স্পর্ধা কর । গায়ের জোর ? তাহা তোমার নাই। কণ্ঠের জোর ? তোমার যেমনি অহংকার থাক সেও তোমার নাই। মুরুবিবর জোর ? সেও তো দেখি না। যদি ধর্মের জোর থাকে। তবে তারই প্রতি সম্পূর্ণ ভরসা রাখো । স্বেচ্ছাপূর্বক দুঃখ পাইবার মহৎ অধিকার হইতে কেহ তোমাকে বঞ্চিত করিতে পরিবে না । সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য, লোকশ্রেয়ের জন্য আপনাকে উৎসর্গ করিবার গৌরব দুৰ্গম পথের প্রান্তে তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। বর। যদি পাই। তবে অন্তর্যামীর কাছ হইতে পাইব ।” দেখ নাই কি, বরদানের সংকল্প-ব্যাপারে ভারত-গবর্মেন্টের উচ্চতম বিভাগের যোগ আছে শুনিয়া এ-দেশী ইংরেজের সংবাদপত্ৰ অট্টহাস্যে প্রশ্ন করিতেছে, “ভারত-সচিবদের স্নায়ুবিকার ঘটিল নাকি । এমন কী উৎপাতের কারণ ঘটিয়াছে যে বজ্ৰপাত-ডিপার্টমেন্ট হইতে হঠাৎ বৃষ্টিপাতের আয়োজন হইতেছে।” অথচ আমাদের ইস্কুলের কচি ছেলেগুলোকে পর্যন্ত ধরিয়া যখন দলে দলে আইনহীন রসাতলের নিরালোক ধামে পাঠানো হয় তখন ইহারাই বলেন, “উৎপাত এত গুরুতর যে, ইংরেজ-সাম্রাজ্যের আইন হার মানিল, মগের মুলুকের বেআইনের আমদানি করিতে হইল।” অর্থাৎ মারিবার বেলায় যে আতঙ্কটা সত্য, মলম দিবার বেলাতেই সেটা সত্য নয় । কেননা মারিতে খরচ নাই, মলম লগাইতে খরচা আছে । কিন্তু তাও বলি, মারিবার খরচার বিল কালে মলমের খরচার চেয়ে বড়ো হইয়া উঠিতে পারে । তোমরা জোরের সঙ্গে ঠিক করিয়া আছ যে, ভারতের যে ইতিহাস ভারতবাসীকে লইয়া, সেটা সামনের দিকে বহিতেছে না ; তাহা ঘূর্ণির মতো একটা প্রবল কেন্দ্রের চারি দিকে ঘুরিতে ঘুরিতে তলার মুখেই কুঁকিতেছে। এমন সময় আপিস হইতে বাহির হইবার কালে হঠাৎ একদিন দেখিতে পাও স্রোতটা তোমাদের নকশার রেখা ছাড়াইয়া কিছু দূর আগাইয়া গেছে। তখন রাগিয়া গৰ্জাইতে গৰ্জাইতে বল, পাথর দিয়া বাধো উসকো, বাঁধ দিয়া উহাকে ঘেরো। প্রবাহ তখন পুথি না পাইয়া উপরের দিক হইতে নীচের দিকে তলাইতে থাকে- সেই চোরা-প্রবাহকে ঠেকাইতে গিয়া সমস্ত দেশের বক্ষ দীর্ণ বিদীর্ণ করিতে থাক । আমার সঙ্গে এই ছোটো-ইংরেজের যে-একটা বিরোধ ঘটিয়াছিল। সে কথা বলি । বিনা বিচারে শতশত লোককে বন্দী করার বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে একখানি ছোটাে চিঠি লিখিয়াছিলাম । ইহাতে ভারতজীবী কোনো ইংরেজি কাগজ আমাকে মিথুক ও extremist বলিয়াছিল । ইহারা ভারতশাসনের তকমাহীন সচিব, সুতরাং আমাদিগকে সত্য করিয়া জানা ইহাদের পক্ষে অনাবশ্যক, অতএব আমি ইহাদিগকে ক্ষমা করিব । এমন-কি, আমাদের দেশের লোক, যারা বলেন আমার পদ্যেও অর্থ নাই, গদ্যেও বস্তু নাই, তাদের মধ্যেও যে দুই-একজন ঘটনাক্রমে আমার লেখা পড়িয়াছেন তাহাদিগকে অন্তত এ কথাটুকু কবুল করিতেই হইবে যে, স্বদেশী উত্তেজনার দিন হইতে আজ পর্যন্ত আমি অতিশয়-পন্থার বিরুদ্ধে লিখিয়া আসিতেছি । আমি এই কথাই বলিয়া আসিতেছি যে, অন্যায় করিয়া যে ফল পাওয়া যায় তাহাতে কখনোই শেষ পর্যন্ত ফলের দাম পোষায় না, অন্যায়ের ঋণটাই ভয়ংকর ভারী হইয়া উঠে । সে যাই হােক, দিশি বা বিলিতি যে-কোনো কালিতেই হােক-না। আমার নিজের নামে কোনো লাঞ্ছনাতে আমি ভয় করিব না। আমার যেটা বলিবার কথা সে এই যে,