পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর ○ SS এখনকার প্রধান সম্বন্ধ হল সংসারের সঙ্গে । অথচ তখনকার সঙ্গে এখনকার দিনের যে এত বড়ো একটা বিচ্ছেদ ঘটেছে, কাজ করতে করতে তা ভুলে গিয়েছিলুম। এই ভোলবার ক্ষমতাই হচ্ছে মনের বিশেষ ক্ষমতা । সে দু নীেকোয় পা দেয় না ; সে যখন একটা নীেকোয় থাকে তখন অন্য নীেকোটাকে পিছনে বেঁধে রাখে । এমন সময় আমার শরীর অসুস্থ হল । সংসারের কাছ থেকে কিছুদিনের মতো ছুটি মিলল । দোতলা ঘরের পুব দিকের প্রান্তে খোলা জানালার ধারে একটা লম্বা কেদারায় ঠেস দিয়ে বসা গেল । দুটাে দিন না-যেতেই দেখা গেল অনেক দূরে এসে পড়েছি, রেলভাড়া দিয়েও এতদূরে আসা যায় না। যখন আমেরিকায় যাই, জাপানে যাই, ভ্রমণের কথায় ভরে ভরে তোমাদের চিঠি লিখে পাঠাই । পথ-খরচাটার সমান ওজনের গৌরব তাদের দিতে হয় । কিন্তু এই যে আমার নিখরচার যাত্রা কাজের পার থেকে অকাজের পারে, তারও ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখা চলে— মাঝে মাঝে লিখব । মুশকিল। এই যে, কাজের মধ্যে মধ্যে অবকাশ মেলে। কিন্তু পুরো অবকাশের মধ্যে অবকাশ বড়ো দুর্লভ ।। আরো একটা কথা এই যে, আমার এই নিখরচার ভ্রমণবৃত্তান্ত বিনা-কড়ি দামের উপযুক্ত নেহাত হালকা হওয়া উচিত- লেখনীর পক্ষে সেই হালকা চাল ইচ্ছা করলেই হয় না ; কারণ লেখনী স্বভাবতই গজেন্দ্ৰগামিনী । জগৎটাকে কেজো অভ্যাসের বেড়ার পারে ঠেলে রেখে অবশেষে ক্ৰমে আমার ধারণা হয়েছিল আমি খুব কাজের লোক । এই ধারণাটা জন্মালেই মনে হয় আমি অত্যন্ত দরকারী ; আমাকে না হলে চলে না । মানুষকে বিনা মাইনেয়। খাটিয়ে নেবার জন্যে প্রকৃতির হাতে যে-সমস্ত উপায় আছে এই অহংকারটা সকলের সেরা । টাকা নিয়ে যারা কাজ করে তারা সেই টাকার পরিমাণেই কাজ করে, সেটা একটা বাধা পরিমাণ ; কাজেই তাদের ছুটি মেলে— বরাদ্দ ছুটির বেশি কাজ করাকে তারা লোকসান বলে গণ্য করে । কিন্তু অহংকারের তাগিদে যারা কাজ করে তাদের আর ছুটি নেই, লোকসানকেও তারা লোকসান জ্ঞান করে না । আমাকে নইলে চলে না, এই কথা মনে করে এতদিন ভারি ব্যস্ত হয়ে কাজ করা গেছে, চোখের পলক ফেলতে সাহস হয় নি। ডাক্তার বলেছে, “এইখানেই বাস করো, একটু থামো ।” আমি বলেছি, “আমি থামলে চলে কই ।” ঠিক এমন সময়ে চাকা ভেঙে আমার রথ এই জানলাটার সামনে এসে থামল । এখানে দাড়িয়ে অনেকদিন পরে ঐ মহাকাশের দিকে তাকালুম । সেখানে দেখি মহাকালের রথযাত্রায় লক্ষ লক্ষ অগ্নিচক্র ঘুরতে ঘুরতে চলেছে ; না উড়ছে ধুলো, না উঠছে শব্দ, না পথের গায়ে একটুও চিহ্ন পড়ছে। ঐ রথের চলার সঙ্গে বাধা হয়ে বিশ্বের সমস্ত চলা অহরহ চলেছে। এক মুহুর্তে আমার যেন চটক ভেঙে গেল । মনে হল স্পষ্ট দেখতে পেলুম, আমাকে না হলেও চলে । কালের ঐ নিঃশব্দ রথচক্র কারও অভাবে, কারও শৈথিল্যে, কোথাও এক তিল বা এক পল বেধে যাবে এমন লক্ষণ তো দেখি নি । “আমি-নইলে-চালে-নার দেশ থেকে “আমি-নইলে-চলের দেশে ধ্যা করে এসে পৌঁচেছি। কেবলমাত্র ঐ ডেস্কের থেকে এই জানলার ধারটুকুতে এসে । কিন্তু কথাটাকে এত সহজে মেনে নিতে পারব না । মুখে যদি-বা মানি, মন মানে না। আমি থাকলেও যা আমি গেলেও তা, এইটেই যদি সত্য হবে তবে আমার অহংকার এক মুহুর্তের জন্যেও বিশ্বে কোথাও স্থান পেলে কী করে । তার টিকে থাকবার জোর কিসের উপরে। দেশকাল জুড়ে আয়োজনের তো অন্ত নেই, তবু এত ঐশ্বর্যের মধ্যে আমাকে কেউ বরখাস্ত করতে পারলে না । আমাকে না হলে চলে না। তার প্রত্যক্ষ প্ৰমাণ এই যে, আমি আছি । আমি যে আছি সেই থাকার মূল্যই হচ্ছে অহংকার। এই মূল্য যতক্ষণ নিজের মধ্যে পাচ্ছি ততক্ষণ নিজেকে টিকিয়ে রাখবার সমস্ত দায় সমস্ত দুঃখ অনবরত বহন করে চলেছি। সেইজন্য বৌদ্ধারা বলেছে, এই অহংকারটাকে বিসর্জন করলেই টিকে থাকার মূল মেরে দেওয়া হয়, কেননা তখন আর টিকে থাকার মজুরি পোষায় না । যাই হােক, এই মূল্য তো কোনো-একটা ভাণ্ডার থেকে জোগানো হয়েছে। অর্থাৎ আমি থাকি এরই