পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর (2 ANO তার সমস্ত চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে । তাই আজ যখনই এই বাতায়নে এসে বসেছি, অমনি দেখি আমাদের আঙিনা থেকে উঠছে দুর্বলের কান্না ; সেই দুর্বলের কান্নায় আমাদের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, সমস্ত অবকাশ গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে দুর্বল যত ভয়ংকর দুর্বল জগতের ইতিহাসে এমন আর কােন 衍、 की । বিজ্ঞানের কৃপায় বাহুবল আজ নিদারুণ দুর্জয় । পালোয়ান আজ জল স্থল আকাশ সর্বত্রই সিংহনাদে তাল ঠুকে বেড়াচ্ছে। আকাশ একদিন মানুষের হিংসাকে আপনি সীমানায় ঢুকতে দেয় নি । মানুষের ত্রুরতা আজ সেই শূন্যকেও অধিকার করেছে। সমুদ্রের তলা থেকে আরম্ভ করে বায়ুমণ্ডলের প্ৰান্ত পর্যন্ত সব জায়গাতেই বিদীর্ণ হৃদয়ের রক্ত বয়ে চলল । এমন অবস্থায়, যখন সবলের সঙ্গে দুর্বলের বৈষম্য এত অত্যন্ত বেশি, তখনো যদি দেখা যায় এত বড়ো বলবানেরও ভীরুতা ঘুচল না, তা হলে সেই ভীরুতার কারণটা ভালো করে ভেবে দেখতে হবে । ভেবে দেখা দরকার। এইজন্যে যে, য়ুরোপে আজকের যে শান্তিস্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে সেই শান্তি টেকসই হবে, কিনা সেটা বিচার করতে হলে এই সমস্ত বলিষ্ঠদের মনস্তত্ত্ব বুঝে দেখা চাই । যুদ্ধ যখন প্রবল বেগে চলছিল, যখন হারের আশঙ্কা জিতের আশার চেয়ে কম ছিল না, তখন সেই দ্বিধাগ্ৰস্ত অবস্থায় সন্ধির শর্তভঙ্গ, অস্ত্ৰাদি প্রয়োগে বিধিবিরুদ্ধতা, নিরস্ত্ৰ শত্রুদের প্রতি বায়ুরথ থেকে অস্ত্ৰবৰ্ষণ প্রভৃতি কাণ্ডকে এ-পক্ষ ‘ক্রাইম অর্থাৎ অপরাধ বলে অভিযোগ করেছিলেন। মানুষ ক্রাইম কখন করে ? যখন সে ধর্মের গরজের চেয়ে আর-কোনো একটা গরজকে প্রবল বলে মনে করে । যুদ্ধে জয়লাভের গরজীটাকেই জার্মানি ন্যায়াচরণের গরজের চেয়ে আশু গুরুতর বোধ করেছিল । এ-পক্ষ যখন সেজন্যে আঘাত পাচ্ছিলেন তখন বলছিলেন, জার্মানির পক্ষে কাজটা একেবারেই ভালো হচ্ছে না ; হােক-না যুদ্ধ, তাই বলে কি আইন নেই, ধর্ম নেই। আর যখন বিজিত প্রদেশে জর্মনি লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিতে দয়াবোধ করে নি তখন আশু প্রয়োজনের দিক থেকে জার্মানির পক্ষে তার কারণ নিশ্চয়ই ছিল । কিন্তু এ-পক্ষে বলেছিল, আশু প্রয়োজন-সাধনাটাই কি মানুষের চরম মনুষ্যত্ব । সভ্যতার কি একটা দায়িত্ব নেই। সেই দায়িত্বরক্ষার চেয়ে যারা উপস্থিত কাজ-উদ্ধারকেই বড়ো মনে করে তারা কি সভ্যসমাজে স্থান পেতে পারে । ধর্মের দিক থেকে এ-সকল কথার একেবারে জবাব নেই। শুনে আমাদের মনে হয়েছিল যুদ্ধের অগ্নিতে এবার বুঝি কলিযুগের সমস্ত পাপ দগ্ধ হয়ে গেল, এতদিন পরে মানুষের দশা ফিরবে, কেননা তার মন ফিরছে । মন না ফিরলে কেবলমাত্র অবস্থা বা ব্যবস্থা পরিবর্তনে কখনোই কোনো ফল পাওয়া य3 = } কিন্তু আমাদের তখন হিসাবে একটা ভুল হয়েছিল। আমাদের দেশে শ্মশান-বৈরাগ্যকে লোকে সন্দেহের চক্ষে দেখে । তার কারণ, প্রিয়জনের আশু মৃত্যুতে মন যখন দুর্বল তখনকার বৈরাগ্যে বিশ্বাস নেই, সবল মনের বৈরাগ্যই বৈরাগ্য । তেমনি যুদ্ধফলের অনিশ্চয়তায় মন যখন দুর্বল তখনকার ধর্মবাক্যকে ষোলো-আনা বিশ্বাস করা যায় না । যুদ্ধে এ-পক্ষের জিত হল। এখন কী করলে পৃথিবীতে শান্তির ভিত পাকা হয় তাই নিয়ে পঞ্চায়েত বসে গেছে । কথা-কাটাকাটি, প্ৰস্তাব-চালাচালি, রাজ্য-ভাগাভাগি চলছে । এই কারখানাঘর থেকে কী আকার এবং কী শক্তি নিয়ে কোন যন্ত্র বেরবে তা ঠিক বুঝতে পারছি নে । আর-কিছু না বুঝি একটা কথা ক্ৰমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে ; এত আগুনেও কলিযুগের অন্ত্যেষ্টিসৎকার হল না, মন বদল হয় নি। কলিযুগের সেই সিংহাসনটা আজ কোনখানে । লোভের উপরে । পেতে চাই, রাখতে চাই, কোনোমতেই কোথাও একটুও কিছু ছাড়তে চাই নে। সেইজন্যেই অতিবড়ো বলিষ্ঠের ভয়, কী জানি যদি দৈবাৎ এখন বা সুদূর কালেও একটুখানি লোকসান হয় । যেখানে লোকসান কোনোমতেই সইবে না, সেখানে আইনের দোহাই, ধর্মের দোহাই মিথ্যে । সেখানে অন্যায়কে কর্তব্য বলে আপনাকে ভোলাতে একটুও সময় লাগে না ; সেখানে দোষের বিচার দোষের