পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ケと রবীন্দ্র-রচনাবলী মাঝখানে পড়ে গেলে, তখন সে হরিণের মতো পালাতে চাইল না, কচ্ছপের মতো লুকোতে চাইল না, সে অসাধ্য সাধন করলে- চকমকি পাথর কেটে কেটে ভীষণতর নখদন্তের সৃষ্টি করলে । যেহেতু জন্তুদের নখদন্ত তাদের বাহিরের দান এইজন্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পরেই এই নখদন্তের পরিবর্তন বা উন্নতি নির্ভর করে । কিন্তু মানুষের নখদন্ত তার অন্তঃকরণের সৃষ্টি ; এইজন্যে সেই পাথরের বর্শাফলকের পরেই সে ভর করে রইল না, তার সমস্ত হাতিয়ার পাথরের কোঠা থেকে লোহার কোঠায় এসে পৌছল। এতে প্ৰমাণ হয় মানুষের অন্তঃকরণ সন্ধান করছে ; যা তার চারি দিকে আছে তাতেই সে আসক্ত হয়ে নেই, যা তার হাতের কাছে নেই তাকে হাতের তলায় আনছে। পাথর আছে তার সামনে, তাতে সে সন্তুষ্ট নয় ; লোহা আছে মাটির নীচে, সেখানে গিয়ে সে ধাক্কা দেয়, পাথরকে ঘষে-মেজে তার থেকে হাতিয়ার তৈরি করা সহজ ; কিন্তু তাতেও তার মন উঠল না, লোহাকে আগুনে গলিয়ে হাতুড়িতে পিটিয়ে ছাচে ঢালাই করে যা সব চেয়ে বাধা দেয় তাকেই আপনার সব চেয়ে অনুগত করে তুললে। মানুষের অন্তঃকরণের ধর্মই হচ্ছে এই, আপনাকে খাটিয়ে কেবল যে তার সফলতা তা নয়, তার আনন্দ ; সে কেবলই উপরিতল থেকে গভীরতলে পৌঁছতে চায়, প্ৰত্যক্ষ থেকে অপ্ৰত্যক্ষে, সহজ থেকে কঠিনে, পরাসক্তি থেকে আত্মকর্তৃত্বে, প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিচারের ব্যবস্থায় । এমনি করে সে জয়ী হয়েছে। কিন্তু কোনো একদল মানুষ যদি বলে, “এই পাথরের ফলা আমাদের বাপ-পিতামহের ফলা, এ ছাড়া আর যা-কিছু করতে যাব তাতে আমাদের জাত নষ্ট হবে, তা হলে একেবারে তাদের মনুষ্যত্বের মূলে ঘা লাগে ; তা হলে যাকে তারা জাতিরক্ষা বলে তা হতে পারে, কিন্তু তাদের সব চেয়ে যে বড়ো জাত মনুষ্যজাত সেইখানে তাদের কৌলীন্য মারা যায় । আজও যারা সেই পাথরের ফলার বেশি এগোয় নি মানুষ তাদের জাতে ঠেলেছে, তারা বনে জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়ায় । তারা বহিরাবস্থার কাছে পরাসক্ত, তারা প্ৰচলিতের জিন-লাগামের টানে চোখে ঠুলি লাগিয়ে চলে ; তারা অন্তরের স্বরাজ পায় নি, বাহিরের স্বরাজের অধিকার থেকে তাই তারা ভ্ৰষ্ট । এ কথা তারা জানেই না যে, মানুষকে আপনার শক্তিতে অসাধ্যসাধন করতে হবে ; যা হয়েছে তার মধ্যে সে বদ্ধ থাকবে না, যা হয় নি। তার দিকে সে এগোবে ; তাল ঠুকে বুক ফুলিয়ে নয়, অন্তঃকরণের সাধনার বলে, আত্মশক্তির উদ্বোধনে । আজ ত্রিশ বৎসর হয়ে গেল, যখন “সাধনা” কাগজে। আমি লিখছিলুম, তখন আমার দেশের লোককে এই কথাই বলবার চেষ্টা করেছি। তখন ইংরেজি-শেখা ভারতবর্ষ পরের কাছে অধিকার-ভিক্ষার কাজে বিষম ব্যস্ত ছিল । তখন বারে বারে আমি কেবল একটি কথা বোঝাবার প্রয়াস পেয়েছি যে মানুষকে অধিকার চেয়ে নিতে হবে না, অধিকার সৃষ্টি করতে হবে। কেননা মানুষ প্রধানত অন্তরের জীব, অন্তরেই সে কর্তা ; বাহিরের লাভে অন্তরে লোকসান ঘটে । আমি বলেছিলেম, অধিকার-বঞ্চিত হবার দুঃখভার আমাদের পক্ষে তেমন বোঝা নয়। যেমন বোঝা আমাদের মাথার উপরে ‘আবেদন আর নিবেদনের থালা' । তার পরে যখন আমার হাতে “বঙ্গদর্শন’ এসেছিল তখন বঙ্গবিভাগের ছুরি-শানানোর শব্দে সমস্ত বাংলাদেশ উতলা । মনের ক্ষোভে বাঙালি সেদিন ম্যাঞ্চেস্টরের কাপড় বর্জন করে বোম্বাই মিলের সদাগরদের লোভটাকে বৈদেশিক ডিগ্রিতে বাড়িয়ে তুলেছিল । যেহেতু ইংরেজ সরকারের পরে অভিমান ছিল এই বস্ত্রবর্জনের মূলে, সেইজনো সেই দিন এই কথা বলতে হয়েছিল “এহ বাহা’ । এর প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ইংরেজ, ভারতবাসী উপলক্ষ, এর মুখ্য উত্তেজনা দেশের লোকের প্রতি প্রেম নয়, বিদেশী লোকের প্রতি ক্ৰোধ । সেদিন দেশের লোককে এই কথা বলে সাবধান করবার দরকার ছিল যে, ভারতে ইংরেজ যে আছে এটা বাইরের ঘটনা, দেশ যে আছে এটাই আমাদের ভিতরের কথা। এই ভিতরের কথাটাই হচ্ছে চিরসত্য, আর বাইরের ব্যাপারটা মায়া । মায়াকে ততক্ষণ অত্যন্ত বড়ো দেখায় যতক্ষণ রাগেই হােক বা অনুরাগেই হােক বাইরের দিক ১ ১৩০০, ১৩০১ সালের সাধনায় প্রকাশিত রাষ্ট্রনৈতিক প্রবন্ধাবলী। রবীন্দ্র-রচনাবলী দশম (সুলভ পঞ্চমু) খণ্ড দ্রষ্টব্য । ২ বঙ্গদর্শন-সম্পাদনার কাল ১৩০৮-১২ ৷