পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@>O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যা-কিছুতে সমস্ত দেশের অন্তঃকরণ উদবোধিত হয় না, অভিভূত হয়, এ কাজের পক্ষে তা অন্তরায় । নিজের সৃষ্টিশক্তির দ্বারা দেশকে নিজের করে তোলবার যে আহবান সে খুব একটা বড়ো আহবান । সে কোনো-একটা বাহ্য অনুষ্ঠানের জন্যে তাগিদ দেওয়া নয়। কারণ, পূর্বেই বলেছি মানুষ তো মৌমাছির মতো কেবল একই মাপে মৌচাক গড়ে না, মাকড়সার মতো নিরন্তর একই প্যাটার্নে জাল বোনে না । তার সকলের চেয়ে বড়ো শক্তি হচ্ছে তার অন্তঃকরণে— সেই অন্তঃকরণের কাছে তার পুরো দাবি, জড় অভ্যাস-পরতার কাছে নয়। যদি কোনো লোভে পড়ে তাকে আজ বলি, তুমি চিন্তা কোরো না, কর্ম করো, তা হলে যে মোহে আমাদের দেশ মরেছে। সেই মোহকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে । এতকাল ধরে আমরা অনুশাসনের কাছে, প্রথার কাছে মানবমনের সর্বোচ্চ অধিকার অর্থাৎ বিচারের অধিকার বিকিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে অলস হয়ে বসে আছি। বলেছি, আমরা সমুদ্রপারে যাব না, কেননা মনুতে তার নিষেধ ; মুসলমানের পাশে বসে খাব না, কেননা শাস্ত্র তার বিরোধী। অর্থাৎ যে প্ৰণালীতে চললে মানুষের মন বলে জিনিসের কোনোই দরকার হয় না, যা কেবলমাত্র চিন্তাহীন অভ্যাসনিষ্ঠতার কাজ, আমাদের সংসারযাত্রার পনেরো-আনা কাজই সেই প্ৰণালীতে চালিত । যে নিয়ত চালিত তাদেরও সেইরকম । কেননা পূর্বেই বলেছি অন্তরের মানুষই প্ৰভু, সে যখন একান্তভাবে বাহ্য প্রথার পরাসক্ত জীব হয়ে ওঠে তখন তার দুৰ্গতির সীমা থাকে না । আচারে চালিত মানুষ কলের পুতুল, বাধ্যতার চরম সাধনায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে। পরতন্ত্রতার কারখানাঘরে সে তৈরি ; এইজন্যে এক চালকের হাত থেকে তাকে নিস্কৃতি দিতে গেলে আর-এক চালকের হাতে সমর্পণ করতে হয়। পদার্থবিদ্যায় যাকে ইনশিয়া বলে, যে মানুষ তারই একান্ত সাধনাকে পবিত্রতা বলে অভিমান করে তার স্থাবরতাও যেমন জঙ্গমতাও তেমন, উভয়েই তার নিজের কর্তৃত্ব নেই। অন্তঃকরণের যে জড়ত্ব সর্বপ্রকার দাসত্বের কারণ, তার থেকে মুক্তি দেবার উপায় চোখে-ঠুলি-দেওয়া বাধ্যতাও নয়, কলের পুতুলের মতো বাহ্যানুষ্ঠানও নয় । বঙ্গবিভাগের আন্দোলনের পরে এবার দেশে যে আন্দোলন উপস্থিত হয়েছে তার পরিমাণ আরো অনেক বড়ো; সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে তার প্রভাব । বহুদিন ধরে আমাদের পোলিটিকাল নেতারা ইংরেজি-পড়া দলের বাইরে ফিরে তােকান নি, কেননা তাদের দেশ ছিল ইংরেজি-ইতিহাস পড়া একটা পুঁথিগত দেশ। সে দেশ ইংরেজি ভাষার বাষ্পরচিত একটা মরীচিকা, তাতে বার্ক গ্লাড়স্টোন ম্যাটসীনি গারিবােলডির অস্পষ্ট মূর্তি ভেসে বেড়াত। তার মধ্যে প্রকৃত আত্মত্যাগ বা দেশের মানুষের প্রতি যথার্থ দরদ দেখা যায় নি । এমন সময় মহাত্মা গান্ধি এসে দাড়ালেন ভারতের বহুকোটি গরিবের দ্বারেতাদেরই আপন বেশে, এবং তাদের সঙ্গে কথা কইলেন তাদের আপনি ভাষায় । এ একটা সত্যকার জিনিস, এর মধ্যে পুঁথির কোনো নজির নেই। এইজন্যেই তাকে যে মহাত্মা নাম দেওয়া হয়েছে। এ তার সত্য নাম । কেননা, ভারতের এত মানুষকে আপনার আত্মীয় করে আর কে দেখেছে। আত্মার মধ্যে যে শক্তির ভাণ্ডার আছে তা খুলে যায় সত্যের স্পর্শমাত্রে। সত্যকার প্ৰেম ভারতবাসীর বহুদিনের রুদ্ধদ্বারে যে মুহুর্তে এসে দাঁড়াল অমনি তা খুলে গেল। কারও মনে আর কার্পণ্য রইল না, অর্থাৎ সত্যের স্পর্শে সত্য জেগে উঠল । চাতুরি দ্বারা যে রাষ্ট্রনীতি চালিত হয় সে নীতি বন্ধ্যা, অনেক দিন থেকে এই শিক্ষার আমাদের দরকার ছিল । সত্যের যে কী শক্তি, মহাত্মার কল্যাণে আজ তা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখেছি ; কিন্তু চাতুরী হচ্ছে ভীরু ও দুর্বলের সহজ ধর্ম, সেটাকে ছিন্ন করতে হলে তার চামড়া কেটে ছিন্ন করতে হয় । সেইজন্যে আজকের দিনেও দেশের অনেক বিজ্ঞ লোকেই মহাত্মার চেষ্টাকেও নিজেদের পোলিটিকাল জুয়োখেলার একটা গোপন চালেরই সামিল করে নিতে চান । মিথ্যায় জীৰ্ণ তাদের মন এই কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, প্রেমের দ্বারা দেশের হৃদয়ে এই যে প্ৰেম উদবেলিত হয়েছে এটা একটা অবান্তর বিষয় নয়- এইটেই মুক্তি, এইটেই দেশের আপনাকে পাওয়া-ইংরেজ দেশে আছে কিনেই এর মধ্যে সে কথার কোনো জায়গাই নেই। এই প্রেম হল স্বপ্রকাশ, এই হচ্ছে হা- কোনো না।’এর সঙ্গে এ তর্ক করতে যায় না, কেননা তর্ক করবার দরকারই থাকে না ।