পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GS8 রবীন্দ্র-রচনাবলী করছে না কি- লোভের বশে উদ্দেশ্য সাধনের খাতিরে মানুষের মনুষ্যত্বকে সংকীর্ণ করে ছেটে দিচ্ছে না কি । আর এইজনেই কি যুরোপীয় সমাজে আজ নিরানন্দ ঘনীভূত হয়ে উঠছে না । বড়ো কলের দ্বারাও মানুষকে ছােটাে করা যায়, ছােটাে কলের দ্বারাও করা যায় । এঞ্জিনের দ্বারাও করা যায়, চরকার দ্বারাও । চরকা যেখানে স্বাভাবিক সেখানে সে কোনো উপদ্রব করে না, বরঞ্চ উপকার করেমানবমনের বৈচিত্রাবশতই চরকা যেখানে স্বাভাবিক নয়। সেখানে চরকায় সূতা কাটার চেয়ে মন কাটা যায় অনেকখানি । মন জিনিসটা সুতার চেয়ে কম মূল্যবান নয় । একটি কথা উঠেছে এই যে, ভারতে শতকরা আশি জন লোক চাষ করে এবং তারা বছরে ছয় মাস বেকার থাকে তাদের সূতা কাটতে উৎসাহিত করবার জনো কিছুকাল সকল ভদ্রলোকেরই চরকা ধরা দরকার । প্ৰথম আবশ্যক হচ্ছে যথোচিত উপায়ে তথ্যানুসন্ধান দ্বারা এই কথাটি প্রতিপন্ন করা । অর্থাৎ কী পরিমাণ চাষ কতদিন পরিমাণ বেকার থাকে । যখন চাষ বন্ধ তখন চাষার কোনো উপায়ে যে পরিমাণ জীবিকা অর্জন করে সূতাকটার দ্বারা তার চেয়ে বেশি অর্জন করবে কি না । চাষ ব্যতিরেকে জীবিকার একটিমাত্র উপায়ের দ্বারা সমস্ত কৃষাণকে বদ্ধ করা দেশের কল্যাণের পক্ষে উচিত কি না সে সম্বন্ধেও সন্দেহ আছে । কিন্তু মূল কথা এই যে, কারও মুখের কথায় কোনো অনুমানমাত্রের উপর নির্ভর করে আমরা সর্বজনীন কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারব না, আমরা বিশ্বাসযোগ্য প্ৰণালীতে তথ্যানুসন্ধান দাবি করি । তার পরে উপায়ের যথাযোগ্যতা সম্বন্ধে বিচার করা সম্ভবপর। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন, দেশের চিত্তশক্তিকে আমরা তো চিরদিনের জন্যে সংকীর্ণ করতে চাই নে, কেবল অতি অল্পকালের জনো । কেনই-বা অল্পকালের জনো । যেহেতু এই অল্পকালের মধ্যে এই উপায়ে আমরা স্বরাজ পাব ? তার যুক্তি কোথায় । স্বরাজ তো কেবল নিজের কাপড় নিজে জোগানো নয় । স্বরাজ তো একমাত্র আমাদের বস্ত্ৰস্বচ্ছলতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় । তার যথার্থ ভিত্তি আমাদের মনের উপর, সেই মন তার বহুধাশক্তির দ্বারা এবং সেই আত্মশক্তির উপর আস্থা দ্বারা, স্বরাজ সৃষ্টি করতে থাকে । এই স্বরাজসৃষ্টি কোনো দেশেই তো শেষ হয় নি- সকল দেশেই কোনো-না-কোনো অংশে লোভ বা মোহের প্ররোচনায় বন্ধনদশা থেকে গেছে । কিন্তু সেই বন্ধনদশার কারণ মানুষের চিত্তে । সে-সকল দেশে নিরন্তর এই চিত্তের উপর দাবি করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও সেই চিত্তের বিকাশের উপরেই স্বরাজ দাড়াতে পারবে । তার জনো কোনো বাহ্য ক্রিয়া বাহ্য ফল নয়, জ্ঞান বিজ্ঞান চাই। দেশের চিত্তপ্রতিষ্ঠিত এই স্বরাজকে অল্পকাল কয়েকদিন চরকা কেটে আমরা পাব, এর যুক্তি কোথায় । যুক্তির পরিবর্তে উক্তি তো কোনোমতেই চলবে না । মানুষের মুখে যদি আমরা দৈববাণী শুনতে আরম্ভ করি তা হলে আমাদের দেশে, যে হাজার রকমের মারাত্মক উপসৰ্গ আছে। এই দৈববাণী যে তারই মধ্যে অন্যতম এবং প্রবলতম হয়ে উঠবে । একবার যদি দেখা যায় যে, দৈববাণী ছাড়া আর-কিছুতেই আমাদের দেশ নড়ে না, তা হলে আশু প্ৰয়োজনের গরজে সকালে সন্ধায় দৈববাণী বানাতে হবে, অন্য সকল রকম বাণীই নিরস্ত হয়ে যাবে। যেখানে যুক্তির অধিকার সেখানে উক্তি দিয়ে যাদের ভোলাতে হবে, তাদের পক্ষে, যেখানে আত্মার অধিকার সেখানে কোনো-না-কোনো কতার আসন পড়বেই । তারা স্বরাজের গোড়া কেটে বসে আছে, আগায় জল ঢেলে কোনো ফল হবে। না । এ কথা মানছি। আমাদের দেশে দৈববাণী দৈব ঔষধ, বাহাব্যাপারে দৈবক্রিয়া, এ-সবের প্রভাব খুবই বেশি- কিন্তু সেইজনো আমাদের দেশে স্বরাজের ভিতপত্তন করতে হলে দৈববাণীর আসনে বিশেষ করে বুদ্ধির বাণীকে পাকা করে বসাতে হবে । কেননা, আমার পূর্বের প্রবন্ধে বলেছি, দৈব স্বয়ং আধিভৌতিক রাজ্যে” বুদ্ধির রাজাভিষেক করেছেন । তাই আজ বাইরের বিশ্বে তারাই স্বরাজ পাবে এবং তাকে রক্ষা করতে পারবে যারা আত্মবুদ্ধির জোরে আত্মকর্তৃত্বের গীেরব উপলব্ধি করতে পারে— যারা সেই গৌরবকে কোনো লোভে কোনো মোহে। পরের পদানত করতে চায় না । এই-যে আজ বস্ত্রাভাবে লজ্জাকাতরা মাতৃভূমির প্রাঙ্গণে রাশীকৃত করে কাপড় পোড়ানো চলছে, কোন বাণীতে দেশের কাছে আজ তার তাগিদ। আসছে। সে কি ঐ দৈববাণীতে নয়। কাপড় ব্যবহার বা বর্জন ব্যাপারে অর্থশান্ত্রিকতত্ত্বের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে, এ-সম্বন্ধে সেই তত্ত্বের ভাষাতেই দেশের সঙ্গে কথা