পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve O, 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মিল আছে, বাইরের কোটি কোটি স্বাধীন লোকদের সঙ্গে কোনো মিল নেই। বৃহতের সঙ্গে এই ভেদ থাকাটাই হচ্ছে বন্ধন। কেননা পূর্বেই বলেছি, ভেদটাই সকল দিক থেকে আমাদের মূল বিপদ ও চরম অমঙ্গল । অবুদ্ধি হচ্ছে ভেদবুদ্ধি, কেননা চিত্তরাজ্যে সে আমাদের সকল মানবের থেকে পৃথক করে দেয়, আমরা একটা অদ্ভুতের খাচায় বসে কয়েকটা শেখানো বুলি আবৃত্তি করে দিন কাটাই । জীবনযাত্রায় পদে পদেই অবুদ্ধিকে মানা যাদের চিরকালের অভ্যাস, চিত্রগুপ্তের কোনো একটা হিসাবের ভুলে হঠাৎ তারা স্বরাজের স্বর্গে গেলেও তাদের টেকি-লীলার শান্তি হবে না, সুতরাং পরপদপীড়নের তালে তালে তারা মাথা কুটে মরবে, কেবল মাঝে মাঝে পদযুগলের পরিবর্তন হবে এইমাত্ৰ প্ৰভেদ । যন্ত্রচালিত বড়ো বড়ো কারখানায় মানুষকে পীড়িত করে যন্ত্রবৎ করে বলে আমরা আজকাল সর্বদাই তাকে কটুক্তি করে থাকি । এই উপায়ে পশ্চিমের সভ্যতাকে গাল পাড়ছি জেনে মনে বিশেষ সাত্মনা পাই । কারখানায় মানুষের এমন পঙ্গুতা কেন ঘটে ; যেহেতু সেখানে তার বুদ্ধিকে ইচ্ছাকে কর্মকে একটা বিশেষ সংকীর্ণ ছাঁচে ঢালা হয়, তার পূর্ণ বিকাশ হতে পারে না । কিন্তু লোহা দিয়ে গড়া কলের কারখানাই একমাত্র কারখানা নয় । বিচারহীন বিধান লোহার চেয়ে শক্ত, কলের চেয়ে সংকীর্ণ । যে বিপুল ব্যবস্থাতন্ত্র অতি নিষ্ঠুর শাসনের বিভীষিকা সর্বদা উদ্যত রেখে বহু যুগ ধরে বহু কোটি মানুষ-পেষা জাতকিল কি কল হিসাবে কারও চেয়ে খাটাে। বুদ্ধির স্বাধীনতাকে অশ্রদ্ধা করে এত বড়ো সুসম্পূর্ণ সুবিস্তীর্ণ চিত্তশূন্য বজ্ৰকঠোর বিধিনিষেধের কারখানা মানুষের রাজ্যে আর কোনোদিন আর কোথাও উদভাবিত হয়েছে বলে আমি তো জানি নে । চটকল থেকে যে পাটের বস্তা তৈরি হয়ে বেরোয় জড়ভাবে বােঝা গ্ৰহণ করবার জন্যেই তার ব্যবহার । মানুষ্য-পেষা কল থেকে ছােটাকাটা যে-সব অতি-ভালোমানুষ পদার্থের উৎপত্তি হয় তারাও কেবল বাহিরের বোঝা বইতেই আছে। একটা বোঝা খালাস হতেই আর-একটা বোঝা তাদের অধিকার করে বসে । প্রাচীন ভারত একদিন যখন বিধাতার কাছে বর চেয়েছিলেন তখন বলেছিলেন- স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনতু, যা একঃ অবৰ্ণঃ- যিনি এক, যিনি বৰ্ণভেদের অতীত, তিনি আমাদের শুভবুদ্ধি দ্বারা সংযুক্ত করুন । তখন ভারত ঐক্য চেয়েছিলেন, কিন্তু পোলিটিকাল বা সামাজিক কলে-গড়া ঐক্যের বিড়ম্বন চান নি । বুদ্ধ্যা শুভয়া, শুভবুদ্ধির দ্বারাই মিলতে চেয়েছিলেম- অন্ধ বশ্যতার লম্বা শিকলের দ্বারা নয়, বিচারহীন বিধানের কঠিন কান-মালার দ্বারা নয় । সংসারে আকস্মিকের সঙ্গে মানুষকে সর্বদাই নতুন করে বোঝাপড়া করতেই হয় । আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির সেই কাজটাই খুব বড়ো কাজ। আমরা বিশ্বসৃষ্টিতে দেখতে পাই, আকস্মিক- বিজ্ঞানে যাকে variation বলে- আচমকা এসে পড়ে । প্রথমটা সে থাকে একঘরে, কিন্তু বিশ্বনিয়ম বিশ্বছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে তাকে সবার করে নেন। অথচ সে এক নূতন বৈচিত্র্যের প্রবর্তন করে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে, মানুষের সমাজে, আকস্মিক প্রায়ই অনাহুত এসে পড়ে। তার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করলে এই নূতন আগন্তুকটি চার দিকের সঙ্গে সুসংগত হয়, অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধিকে রুচিকে চারিত্রকে, আমাদের কােণ্ডজ্ঞানকে, পীড়িত অবমানিত না করে, সতর্ক বুদ্ধি দ্বারাতেই সেটা সাধন করতে হয়। মনে করা যাক, একদা এক ফকির বিশেষ প্রয়োজনে রাস্তার মাঝখানে খুঁটি পুতে র্তার ছাগলটাকে বেঁধে হাট করতে গিয়েছিলেন । হাটের কােজ সারা হল, ছাগলটােরও একটা চরম সদগতি হয়ে গেল । উচিত ছিল, এই আকস্মিক খুঁটিটাকে সর্বকালীনের খাতিরে রাস্তার মাঝখান থেকে উদ্ধার করা । কিন্তু উদ্ধার করবে। কে । অবুদ্ধি করে না, কেননা তার কাজ হচ্ছে যা আছে তাকেই চোখ বুজে স্বীকার করা ; বুদ্ধিই করে, যা নূতন এসেছে তার সম্বন্ধে সে বিচারপূর্বক নুতন ব্যবস্থা করতে পারে । যে দেশে যা আছে তাকেই স্বীকার করা- যা ছিল তাকেই পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা সনাতন পদ্ধতি, সে দেশে খুঁটিটা শত শত বৎসর ধরে রাস্তার মাঝখানেই রয়ে গেল। অবশেষে একদিন খামক কোথা থেকে একজন ভক্তিগদগদ মানুষ এসে তার গায়ে একটু সিঁদুর লেপে তার উপর একটা মন্দির তুলে