পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর VVS এইরকমে পিপড়ে-সমাজের নকলে খুচরো কাজ চালাবার খুব সুবিধে, কিন্তু মানুষ হবার বিশেষ বাধা । যে মানুষ কর্তা, যে সৃষ্টি করে, এতে তার মন যায় মারা , যে মানুষ দাস, যে মজুরি করে, তারই দেহের নৈপুণ্য পাকা হয় । তাই বহুকাল থেকে ভারতবর্ষে কেবলই পুরাতনের পুনরাবৃত্তি । এবং সেই পুনরাবৃত্তির জাত চালিয়ে চালিয়েই অস্তিত্বের প্রতি ভারতের এত বিতৃষ্ণা । তাই সে জন্ম-জন্মান্তরের পুনরাবর্তন-কল্পনায় আতঙ্কিত হয়ে সকল কর্ম ও কর্মের মূল মেরে দেবার জন্যে চিত্তবৃত্তি নিরোধ করবার কথা ভাবছে। এই পুনরাবৃত্তির বিভীষিকা সে আপন প্রতিদিনের অভ্যাস-জড় কর্মচক্রের ঘুরপাকের মধ্যেই দেখেছে। লোকসান শুধু এইটুকু নয়, এমনি করে যারা কল বনে গেল তারা বীৰ্য হারালো, কোনো আপদকে ঠেকাবার শক্তিই তাদের রইল না । যুগ যুগ ধরে চতুর তাদের ঠকাচ্ছে, গুরু তাদের ভোলাচ্ছে, প্ৰবল তাদের কান-মলা দিচ্ছে । তারা এর কোনো অন্যথা কল্পনামাত্র করতে পারে না, কারণ তারা জানে মেরে রেখেছেন বিধাতা ; সৃষ্টির আদিকাল চতুমুখ তাদের চাকায় দম দিয়ে বসে আছেন, সে দম সৃষ্টির শেষকাল পর্যন্ত ফুরোবে না। একঘেয়ে কাজের জীবনমৃত্যুর ভেলার মধ্যে কালস্রোতে তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সনাতন শাস্ত্ৰ যাই বলুন-না, সৃষ্টির গোড়ায় ব্ৰহ্মা মানুষকে নিয়ে যে কাণ্ড করেছিলেন এর সঙ্গে তার সম্পূর্ণই তফাত । মানুষের খোলের মধ্যে ঘূর্ণিচাকার মােটর-কল না বসিয়ে মন বলে অত্যন্ত ছটফট একটা পদার্থ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই বালাইটাকে বিদায় করতে না পারলে মানুষকে কল করে তোলা দুঃসাধ্য। ঐহিক বা পারিত্রিক ভয়ে বা লোভে বা মোহমন্ত্রে এই মনটাকে আধমরা করে তবে কর্তারা এক দলের কাছে কেবলই আদায় করছেন তাতের কাপড়, আর-এক দলের কাছে কেবলই ঘানির তেল ; এক দল কেবলই জোগাচ্ছে তাদের ফরমাশের হাড়ি, আর-এক দল বানাচ্ছে লাঙলের ফাল ; তার পরে যদি দরকার হয় মনুষ্যোচিত কোনো বড়ো কাজে তাদের মন পেতে তারা বলে বসে, “মন ? সেটা আবার কোন আপদ।। হুকুম করো-না কেন । মন্ত্র আওড়াও ” গাছ বসিয়ে বেড়া তৈরি করতে গেলে সব গাছকেই সমান খাটো করে ছাঁটতে হয় । তেমনি করে আমাদের এই ছটা মনের মুলুকে মানুষের চিত্তধর্মকে যুগে যুগে দাবিয়ে রেখেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকেকার অবাধ্যতার যুগে এ দিকে ও দিকে তার গোটাকতক ডালপালা বিদ্রোহী হয়ে সাম্যাসীেষম্যকে অতিক্রম করে যদি বেরিয়ে পড়বার দুষ্টলক্ষণ দেখায়, যদি সকলেরই মন আজ আঁধার রাতের ঝিল্লিধ্বনির মতো মৃদু গুঞ্জনে একটিমাত্র উপদেশমস্ত্রের সমতান-অনুকরণ না করে, তা হলে কেউ যেন উদবিগ্ন বা বিরক্ত না হন ; কেননা স্বরাজের জন্যে আশা করা তখনই হবে খাটি । এইজন্যেই কবুল করতে লজ্জা হচ্ছে না। (যদিও লোকভয় যথেষ্ট আছে) যে, এ পর্যন্ত চরকার আন্দোলনে আমার মন ভিতর থেকে দোল খায় নি । অনেকে সেটাকে আমার স্পর্ধা বলে মনে করবেন, বিশেষ রাগ করবেন। কেননা বেড়াজালে যখন অনেক মাছ পড়ে, তখন যে মাছটা ফসকে যায় তাকে গাল না পাড়লে মন খোলসা হয় না। তথাপি আশা করি, আমার সঙ্গে প্রকৃতিতে মেলে এমন লোকও অনেক আছেন । তাদের সকলকে বাছাই করে নেওয়া শক্ত ; কেননা চরকা সম্বন্ধে তাদের সকলের হাত চলে না, অথচ মুখ খুব মুখর বেগেই চলে । যে-কোনো সমাজেই কর্মকাণ্ডকে জ্ঞানকাণ্ডের উপরে বসিয়েছে, সেইখানেই মানুষের সকল বিষয়ে পরাভব । বুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে ভারতের মধ্যযুগের সাধু সাধক যাদেরই দেখি, যারাই এসেছেন। পৃথিবীতে কোনো মহাবার্তা বহন করে, তারা সকলেই আমনস্ক যান্ত্রিক বাহ্যিক আচারের বিরোধী । তারা সব বাধা ভেদ করে কথা কয়েছিলেন মানুষের অন্তরাত্মার কাছে। তারা কৃপণের মতো, হিসাবি বিজ্ঞলোকের মতো এমন কথা বলেন নি যে, আগে বাহ্যিক, তার পরে আন্তরিক ; আগে অন্নবস্ত্র, তার পরে আত্মশক্তির পূর্ণতা । তারা মানুষের কাছে বড়ো দাবি করে তাকে বড়ো সম্মান দিয়েছিলেন ; আর সেই বড়ো সম্মানের বলেই তার অন্তনিহিত প্রচ্ছন্ন সম্পদ বিচিত্ৰভাবে প্রকাশিত হয়ে সাহিত্যে, গানে, নানা কারুকলায় সমাজকে সমৃদ্ধিশালী করেছিল। তারা মানুষকে দিয়েছিলেন আলো, দিয়েছিলেন