পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\\ኃ(፩ O রবীন্দ্র-রচনাবলী এই কারণে আমি মনে করি, দেশকে যদি স্বরাজসাধনায় সত্য ভাবে দীক্ষিত করতে চাই তা হলে সেই স্বরাজের সমগ্র মূর্তি প্রত্যক্ষগোচর করে তোলবার চেষ্টা করতে হবে । অল্পকালেই সেই মূর্তির আয়তন যে খুব বড়ো হবে এ কথা বলি নে ; কিন্তু তা সম্পূর্ণ হবে, সত্য হবে, এ দাবি করা চাই । প্ৰাণবিশিষ্ট জিনিসের পরিণতি প্ৰথম থেকেই সমগ্রতার পথ ধরে চলে । তা যদি না হত তা হলে শিশু প্রথমে কেবল পায়ের বুড়ো আঙুল হয়ে জন্মাত ; তার পরে সেটা ধীরে ধীরে হত হাঁটু পর্যন্ত পা ; তার পরে ১৫ । ২০ বছরে সমগ্ৰ মানবদেহটা দেখা দিত । শিশুর মধ্যে সমগ্রতার আদর্শ প্রথম থেকেই আছে, তাই তার মধ্যে আমরা এত আনন্দ পাই । সেই আনন্দে তাকে মানুষ করে তোলবার কঠিন দুঃখও মা-বাপ স্বীকার করতে পারে । নইলে যদি একখানা আজানু পা নিয়েই তাদের চার-পাঁচ বছর কাটাতে হত, তা হলে সেই আংশিকের দাসত্ব তাদের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠত । স্বরাজকে যদি প্রথমে দীর্ঘকাল কেবল চরকায় সুতো আকারেই দেখতে থাকি তা হলে আমাদের সেই দশাই হবে । এইরকম অন্ধ সাধনায় মহাত্মার মতো লোক হয়তো কিছুদিনের মতো আমাদের দেশের একদল লোককে প্রবৃত্ত করতেও পারেন, কারণ র্তার ব্যক্তিগত মাহান্ত্র্যের পরে তাদের শ্রদ্ধা আছে । এইজন্যে তার আদেশ পালন করাকেই অনেকে ফললাভ বলে গণ্য করে । আমি মনে করি, এরকম মতি স্বরাজলাভের পক্ষে অনুকুল নয় । স্বদেশের দায়িত্বকে কেবল সুতো কাটায় নয়, সম্যকভাবে গ্রহণ করবার সাধনা ছোটাে ছোটাে আকারে দেশের নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা আমি অত্যাবশ্যক মনে করি । সাধারণের মঙ্গল জিনিসটা অনেকগুলি ব্যাপারের সমবায় । তারা পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত | তাদের একটাকে পৃথক করে নিলে ফল পাওয়া যায় না । স্বাস্থ্যের সঙ্গে, বুদ্ধির সঙ্গে, জ্ঞানের সঙ্গে, কর্মের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারলে তবেই মানুষের সব ভালো পূর্ণ ভালো হয়ে ওঠে । স্বদেশের সেই ভালোর রূপটিকে আমরা চোখে দেখতে চাই । সহস্র উপদেশের চেয়ে তাতে আমরা কাজ পাব । বিশেষ বিশেষ লোকালয়ে সাধারণের কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব প্ৰত্যেকে কোনো না-কোনো আকারে গ্রহণ করে একটি সুস্থ জ্ঞানবান শ্ৰীসম্পন্ন সম্মিলিত প্ৰাণ যাত্রার রূপকে জাগিয়ে তুলেছে, এমন-সকল দৃষ্টান্ত চোখের সামনে ধরা দরকার । নইলে স্বরাজ কাকে বলে সে আমরা সুতো কেটে, খদ্দর পরে, কথার উপদেশ শুনে কিছুতেই বোঝাতে পারব না । যে জিনিসটাকে সমস্ত ভারতবর্ষে পেতে চাই ভারতবর্ষের কোনো-একটা ক্ষুদ্র অংশে তাকে যদি স্পষ্ট করে দেখা যায়, তা হলে সার্থকতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জন্মাবে। তা হলে আত্মপ্রভাবের যে কী মূল্য তা বুঝতে পারব ; ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন, বুঝব তার সাক্ষাৎ দর্শনের দ্বারা । ভারতবর্ষের একটিমাত্র গ্রামের লোকও যদি আত্মশক্তির দ্বারা সমস্ত গ্রামকে সম্পূর্ণ। আপন করতে পারে তা হলেই স্বদেশকে স্বদেশকাপে লাভ করবার কাজ সেইখানেই আরম্ভ হবে । জীবজন্তু স্থানবিশেষে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু জন্মগ্রহণের দ্বারাই দেশ তার হয় না । মানুষ আপন দেশকে আপনি সৃষ্টি করে । সেই সৃষ্টির কাজে ও রক্ষণের কাজে দেশের লোকের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ হয়, আর সেই সৃষ্টিকরা দেশকে তারা প্ৰাণের চেয়ে ভালোবাসতে পারে। আমাদের দেশের মানুষ দেশে জন্মাচ্ছে মাত্র, দেশকে সৃষ্টি করে তুলছে না ; এইজন্যে তাদের পরস্পর মিলনের কোনো গভীর উপলক্ষ নেই, দেশের অনিষ্টে তাদের প্রত্যেকের অনিষ্টবােধ জাগে না । দেশকে সৃষ্টি করার দ্বারাই দেশকে লাভ করবার সাধনা আমাদের ধরিয়ে দিতে হবে । সেই সৃষ্টির বিচিত্র কর্মে মানুষের বিচিত্ৰ শক্তির প্রয়োজন ; নানা পথে এক লক্ষ্য-অভিমুখে সেই বিচিত্র শক্তির প্রয়োগের দ্বারাই আমরা আপনাকে দেশের মধ্যে উপলব্ধি করি । এই দেশসৃষ্টির সাধনা কাছের থেকে আরম্ভ করে ক্রমে দূরে প্রসারিত করলে তবেই আমরা ফল পাব । যদি এইরকম উদযোগকে আমরা আয়তনে ছোটাে বলে অবজ্ঞা করি তবে গীতার সেই কথাটা যেন মনে আনি— স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ । সত্যের জোর আয়তনে নয়, তার আপনাতেই । সম্মিলিত আত্মকর্তৃত্বের চর্চা, তার পরিচয়, তার সম্বন্ধে গৌরববোধ জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত হলে তবেই সেই পাকা ভিত্তির উপর স্বরাজ সত্য হয়ে উঠতে পারে । যখন গ্রামে গ্রামে অন্তরে বাহিরে তার