পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর که ما با স্পেনেও এই ধৰ্মহননের আগুন উদ্দীপ্ত । মেক্সিকোয় বিদ্রোহ বারে বারে রোমক চার্চকে আঘাত করতে উদ্যত । নব্য তুর্কী যদিও প্রচলিত ধর্মকে উন্মলিত করে নি, কিন্তু বলপূর্বক তার শক্তি হ্রাস করেছে । এর ভিতরকার কথাটা এই যে, বিশেষ ধর্মের আদি প্রবর্তকগণ দেবতােব নামে মানুষকে মেলাবার জন্যে, তাকে লোভ দ্বেষ অহংকার থেকে মুক্তি দেবার জন্যে উপদেশ দিয়েছিলেন । তার পরে সম্প্রদায়ের লোক মহাপুরুষদের বাণীকে সংঘবদ্ধ করে বিকৃত করেছে, সংকীর্ণ করেছে ; সেই ধর্ম দিয়ে মানুষকে তারা যেমন ভীষণ মার মেরেছে এমন বিষয়বুদ্ধি দিয়েও নয় ; মেরেছে প্ৰাণে মানে বুদ্ধিতে শক্তিতে, মানুষের মহােৎকৃষ্ট ঐশ্বৰ্যকে ছারখার করেছে । ধমের নামে পুরাতন মেক্সিকোয় স্পেনীয় খৃস্টানদের অকথ্য নিষ্ঠুরতার তুলনা নেই । পৃথিবীতে অপ্ৰতিহত প্ৰভুত্ব নিয়ে রাজা যেমন কতবার দুর্দান্ত অরাজকতায় মত্ত হয়েছে, প্রজার রক্ষাকর্তা নাম নিয়ে প্রজার সর্বনাশ করতে কুষ্ঠিত হয় নি, এবং অবশেষে সেই কারণেই আজকের ইতিহাসে রাজ্য থেকে রাজার কেবলই বিলুপ্তি ঘটছে, ধর্ম সম্বন্ধেও অনেক স্থলে সেই একই কারণে ধর্মতন্ত্রের নিদারুণ অধাৰ্মিকতা দমন করবার জন্যে, মানুষকে ধর্মপীড়া থেকে বাচাবার জন্যে অনেকবার চেষ্টা দেখা গেল । আজ সেই সেই দেশেই প্ৰজা যথার্থ স্বাধীনতা পেয়েছে যে দেশে ধর্মমোহ মানুষের চিত্তকে অভিভূত করে এক-দেশ-বাসীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি ঔদাসীন্য বা বিরোধকে নানা আকারে ব্যাপ্ত করে না রেখেছে { হিন্দুসমাজে আচার নিয়েছে ধর্মের নাম । এই কারণে আচারের পার্থক্যে পরস্পরের মধ্যে কঠিন বিচ্ছেদ ঘটায় । মৎসাশী বাঙালিকে নিরামিষ প্রদেশের প্রতিবেশী। আপনি বলে মনে করতে কঠিন বাধা পায় । সাধারণত বাঙালি অন্য প্রদেশে গিয়ে অভ্যস্ত আচারের ব্যতিক্রম উপলক্ষে অবজ্ঞা মনের মধ্যে পোষণ করে । যে চিত্তবৃত্তি বাহ্য আচারকে অত্যন্ত বড়ো মূল্য দিয়ে থাকে তার মমত্ববোধ সংকীর্ণ হতে বাধা । রাষ্ট্ৰসম্মিলনীতেও এই অভাব কথায় কথায় ধরা পড়ে এবং দেখা যায়, আমরা যে অলক্ষ্য ব্যবধান সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াই তা সংস্কারগত, অতি সূক্ষ্ম এবং সেইজন্য অতি দুর্লঙঘ্য । আমরা যখন মুখে তাকে অস্বীকার করি তখনো নিজের অগোচরেও সেটা অন্তঃকরণের মধ্যে থেকে যায় । ধর্ম আমাদের মেলাতে পারে নি, বরঞ্চ হাজারখানা বেড়া গড়ে তুলে সেই বাধাগুলোকে ইতিহাসের অতীত শাশ্বত বলে পাকা করে দিয়েছে । ইংরেজ নিজের জাতকে ইংরেজ বলেই পরিচয় দেয় । যদি বলত খৃস্টান তা হলে যে ইংরেজ বৌদ্ধ বা মুসলমান বা নাস্তিক তাকে নিয়ে রাষ্ট্রগঠনে মাথা ঠোকাঠুকি বোধে যেত । আমাদের প্রধান পরিচয় হিন্দু বা মুসলমান । এক দলকে বিশেষ পরিচয়কালে বলি বাটে হিন্দুস্থানি, কিন্তু তাদের হিন্দুস্থান বাংলার বাইরে । কয়েক বছর পূর্বে আমার ইংরেজ বন্ধু এন্ডজকে নিয়ে মালাবারে ভ্ৰমণ করছিলুম। ব্ৰাহ্মণপল্লীর সীমানায় পা বাড়াতেই টিয়া-সমাজ-ভুক্ত একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করে দৌড় দিলেন । এন্ডজ বিস্মিত হয়ে তাকে গিয়ে ধরলেন এবং প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাতে জানলেন, এ পাড়ায় তাদের জাতের প্রবেশ নিষেধ । বলা বাহুল্য, হিন্দুসমাজবিধি-অনুসারে এন্ডজের আচার বিচার টিয়া-ভদ্রলোকের চেয়ে অনেক গুণে অশাস্ত্রীয় । শাসনকর্তার জাত বলে তার জোর আছে, কিন্তু হিন্দু বলে হিন্দুর কাছে আত্মীয়তার জোর নেই । তার সম্বন্ধে হিন্দুর দেবতা পর্যন্ত জগত বঁচিয়ে চলেন, স্বয়ং জগন্নাথ পর্যন্ত প্ৰত্যক্ষদর্শনীয় নন । বৈমাত্ৰ সন্তানও মাতার কোলের অংশ দাবি করতে পারে।-- ভারতে বিশ্বমাতার কোলে এত ভাগ কেন । অনাত্মীয়তাকে অস্থিমজায় আমরা সংস্কারগত করে রেখেছি, অথচ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে তাদের আত্মীয়তা না পেলে আমরা বিস্মিত হই । শোনা গিয়েছে, এবার পূর্ববঙ্গে কোথাও কোথাও হিন্দুর প্রতি উৎপাতে নমশদ্ররা নির্দয়ভাবে মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল । ভাবতে হবে না কি, ওদের দরদ হল না কেন, আত্মীয়তার দায়িত্বে বাধা পড়ল কোথায় । এই অনাস্ত্রীয়তার অসংখ্য অন্তরাল বহু যুগ ধরে প্রকাশ্যে আমাদের রাষ্ট্রভােগ্যকে ব্যর্থ করেছে এবং আজও ভিতরে ভিতরে আমাদের দুঃখ ঘটাচ্ছে । জোর গলায় যেখানে বলছি আমরা এক, সূক্ষ্ম সুরে সেখানে অন্তর্যামী আমাদের মর্মস্থানে বসে বলছেন, ‘ধর্মে-কর্মে আচারে।-বিচারে এক হবার মতো ঔদার্য SS 8 S.