পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর (? আনুষ্ঠানিক ধর্ম কর্মকাণ্ড আকারে প্রধান হয়ে উঠেছিল। অন্য সময়ে সে জ্ঞানের প্রাধান্য স্বীকার করে বিশ্বভৌমিকতাকে বরণ করেছে । তখন এই বাণী উঠিল যে, নিরর্থক কৃচ্ছসাধন নয়, আত্মপীড়ন নয়, সত্যই তপস্যা, দান তপস্যা, সংযম তপস্যা । ক্রিয়াকাণ্ড স্বভাবতই সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ, সে সকলের নয়, সে বিশেষ দলের অনুষ্ঠান, সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান । যে ধর্ম শুধু বাহ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে শঙ্খলিত তাতে কার কী প্রয়োজন । অগ্নিকুণ্ডেব মধ্যে আপনার প্রাণ আহুতি দিয়ে ব্যক্তিবিশেষ যে অদ্ভুত কর্ম করল তাতে কার কী এল গেল । কিন্তু, যিনি সত্যকার যোগী সকলের সঙ্গে যোগে তিনি বিশ্বাত্মাব সঙ্গে যুক্ত ; তিনি বললেন, যা-কিছু মঙ্গল, যা সকলের ভালোর জন্য, তাই তপস্যা | তখন বন্ধ দুযার খুলে গেল । দ্রব্যময় যজ্ঞে মানুষ শুধু নিজের সিদ্ধি খোজে ; জ্ঞানযজ্ঞে সকলেরই আসন পাতা হল, সমস্ত মানুষের মুক্তির আয়োজন সেইখানে । এই কথা স্বীকার করবামাত্র সভ্যতার নূতন অধ্যায় আরম্ভ হয় । ভগবদগীতায় আমরা এই নৃতনের আভাস পাই, যেখানে ত্যাগের দ্বারা কর্মকে বিশুদ্ধ করবার কথা বলা হয়েছে, নিরর্থক অনুষ্ঠানের মধ্যে তাকে আবদ্ধ রাখতে বলে নি । ইহুদিদের মধ্যেও দেখি, ফ্যাবিসিরা ংস্কার ও অনুষ্ঠানকেই বড়ো স্থান দিযে আসছিল । যীশু বললেন, এ তো বড়ো কথা নয়— কী খেলে কী পরলে তা দিয়ে তো লোক শুচি হয় না, অন্তরে সে কী তাই দিয়ে শুচিতার বিচার । এ নূতন যুগের চিরন্তন বাণী । আমাদের যদি আজ শুভবুদ্ধি এসে থাকে। তবে সকলকেই আমরা সম্মিলিত করবার সাধনা করব । আজ ভাববার সময় এল । মানুষের স্পর্শে অশুচিতার আরোপ করে অবশেষে সেই স্পর্শে দেবতারও শুচিতনাশ কল্পনা করি । এ বুদ্ধি হারাই যে, তাতে দেবতার স্বভাবকে নিন্দ কবা হয় । তখন আমরা সম্প্রদায়ের মন্দিরে অর্ঘ্য আনি, বিশ্বনাথের মন্দিরের বিশ্বদ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে তার অবমাননা করি । মানুষকে লাঞ্ছিত করে হীন করে রেখে পুণ্য বলি কাকে ! আমি এক সময় পদ্মাতীরে নৌকোয় ছিলেম । একদিন আমার কানো এল, একজন বিদেশী রুগণ হয়ে শীতের মধ্যে তিন দিন নদীর ধারে পড়ে আছে । তখন কোনো একটা যোগ ছিল । সেই মুম্ষুর ঠিক পাশ দিয়েই শত শত পুণ্যকামী বিশেষ স্থানে জলে ডুব দিয়ে শুচি হবার জন্য চলেছে । তাদের মধ্যে কেউ পীড়িত মানুষকে ছুল না । সেই অজ্ঞাতকুলশীল পীড়িত মানুষের সামান্য মাত্র সেবা করলে তারা অশুচি হত, শুচি হবে জলে ডুব দিয়ে । জাত বলে একটা কোন পদার্থ তাদেব আছে মানব-জাতীয়তার চেয়েও তাকে বড়ো বলে জেনেছে । যদি কারও মনে দয়া আসত, সেই দয়ার প্রভাবে সে যদি তার বারুণী:স্নান ত্যাগ করে ঐ মানুষটিকে নিজের ঘরে নিয়ে সেবা করত, তা হলে সমাজের মতে কেবল যে বারুণীর সানের পুণ্য সে হারাত তা নয়, সে দণ্ডনীয় হত, তাকে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হত । তার ঘরে এসে রোগী যদি মরত তা হলে সমাজে সে বিষম বিপন্ন হয়ে পড়ত । যে মানবধর্ম সকল নিরর্থক আচারের বহু উর্ধের্ব তাকে দণ্ড মেনে নিতে হবে আচারীদের হাতে । একজন প্রাচীন অধ্যাপক আমাকে বললেন, তার গ্রামের পথে ধূলিশায়ী আমাশয়-রোগে-পীড়িত একজন বিদেশী পথিককে তিনি হাটের টিনের চালার নীচে স্থান দিতে অনুরোধ করেছিলেন । যার সেই চালা সে বললে, পারব না । তিনিও লজার সঙ্গে স্বীকার করলেন যে, তিনিও সমাজের দণ্ডের ভয়েই তাকে আশ্রয় দিতে পারেন নি। অর্থাৎ মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্যসাধন শাস্তির যোগ্য । তিনি হােমিওপ্যাথি জানতেন, পথের ধারেই তাকে কিছু ওষুধপত্র দিয়েছিলেন । আরোগ্যের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় রাত্রে শিলাবৃষ্টি হল ; পরদিন সকালে দেখা গেল, সে মরে পড়ে আছে। পাপপুণ্যের বিচার এত বড়ো বীভৎসতায় এসে ঠেকেছে। মানুষকে ভালোবাসায় অশুচিতা, তাকে মনুষ্যোচিত সম্মান করায় অপরাধ। আর জলে ডুব দিলেই সব অপরাধের ক্ষালন । এর থেকে মনে হয়, যে অভাব মানুষের সকলের চেয়ে বড়ো অভাব সে প্রেমের অভাব । সে প্রেমের অভাবকে হৃদয়ে নিয়ে আমরা যাকে শুচিতা বলে থাকি তাকে রক্ষা করতে পারি, কিন্তু মনুষ্যত্বকে বাচাতে পারি। নে । আশা করি, দুৰ্গতির রাত্রি-অবসানে দুৰ্গতির শেষ সীমা আজ পেরোবার সময় এল। আজ নবীন যুগ এসেছে। আর্যে-অনার্যে একদা যেমন মিলন ঘটেছিল, শ্ৰীরামচন্দ্র যেমন চণ্ডালকে বুকে বেঁধেছিলেন,