পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২১৫ চারু পরদিন সকালে ঈষৎ কলহের স্বরে জিজ্ঞাসা করিত, “কই, তুমি সেট। লিখলে না ?” অমল বলিত, “রোসো, আর-একটু ভাবি।” চারু রাগ করিয়া বলিত, “তবে যাও।” বিকালে সেই রাগ ঘনীভূত হইয়া চারু যখন কথা বন্ধ করিবার জো করিত তখন অমল লেখা কাগজের একটা অংশ রুমাল বাহির করিবার ছলে পকেট হইতে একটুখানি বাহির করিত। মুহূর্তে চারুর মৌন ভাঙিয়া গিয়া সে বলিয়া উঠিত, “ওই-ষে তুমি লিখেছ! আমাকে ফাকি ! দেখাও।” অমল বলিত, “এখনো শেষ হয় নি, আর-একটু লিখে শোনাব।” চারু। না, এখনই শোনাতে হবে । অমল এখনই শোনাইবার জন্যই ব্যস্ত ; কিন্তু চারুকে কিছুক্ষণ কড়াকড়ি না করাইয়া সে শোনাইত না । তার পরে অমল কাগজখানি হাতে করিয়া বসিয়া প্রথমটা একটুখানি পাতা ঠিক করিয়া লইত, পেনসিল লইয়। দুই-এক জায়গায় দুটোএকটা সংশোধন করিতে থাকিত, ততক্ষণ চারুর চিত্ত পুলকিত কৌতুহলে জলভারনত মেঘের মতো সেই কাগজ কয়খানির দিকে ঝুকিয়া রহিত । অমল দুই-চারি প্যারাগ্রাফ যখন যাহা লেখে তাহা যতটুকুই হোক চারুকে সদ্য সদ্য শোনাইতে হয়। বাকি অলিখিত অংশটুকু আলোচনা এবং কল্পনায় উভয়ের মধ্যে মথিত হইতে থাকে । এতদিন দুজনে আকাশকুমুমের চয়নে নিযুক্ত ছিল, এখন কাব্যকুসুমের চাষ আরম্ভ হইয়া উভয়ে আর-সমস্তই ভুলিয়া গেল । একদিন অপরাহুে অমল কলেজ হইতে ফিরিলে তাহার পকেটটা কিছু অতিরিক্ত ভরা বলিয়া বোধ হইল। অমল যখন বাড়িতে প্রবেশ করিল তখনই চারু অন্তঃপুরের গবাক্ষ হইতে তাহার পকেটের পূর্ণতার প্রতি লক্ষ করিয়াছিল। অমল অন্তদিন কালেজ হইতে ফিরিয়া বাড়ির ভিতরে আসিতে দেরি করিত না ; আজ সে তাহার ভর পকেট লইয়া বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিল, শীঘ্ৰ আসিবার নাম করিল না। চারু অন্তঃপুরের সীমান্তদেশে আসিয়া অনেকবার তালি দিল, কেহ শুনিল না। চারু কিছু রাগ করিয়া তাহার বারান্দায় মন্মথ দত্তর এক বই হাতে করিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিল ।