পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २७१ বিরোধী পক্ষের উকিল উঠিয়৷ বলিলেন, “আমার বিদ্বান বন্ধু যদি তাহার বিদুষী স্ত্রীর কাছে এই উইলটি বুঝিয়া লইয়। আদিতেন, তবে এমন অদ্ভুত ব্যাখ্যা দ্বার। মাতৃ ভাষাকে ব্যথিত করিয়া তুলিতেন না।” চুলায় আগুন ধরাইবার বেল ফু দিতে দিতে নাকের জলে চোখের জলে হইতে হয়, কিন্তু গৃহদাহের আগুন নেবানোই দায়। লোকের ভালো কথা চাপা থাকে, আর অনিষ্টকর কথাগুলো মুখে মুখে হুহু: শব্দে ব্যাপ্ত হইয়া যায়। এ গল্পটিও সর্বত্র প্রচারিত হইল। ভয় হইয়াছিল, পাছে আমার স্ত্রীর কানে ওঠে। সৌভাগ্যক্রমে ওঠে নাই— অন্তত এ সম্বন্ধে তাহার কাছ হইতে কোনো আলোচনা কখনো শুনি मांझे । একদিন একটি অপরিচিত ভদ্রলোকের সহিত আমার পরিচয় হইতেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনিই কি শ্ৰীমতী নিঝরিণী দেবীর স্বামী।” আমি কহিলাম, *আমি তাহার স্বামী কি না সে কথার জবাব দিতে চাহি না, তবে তিনিই আমার স্ত্রী বটেন।” বাহিরের লোকের কাছে স্ত্রীর স্বামী বলিয়া থ্যাতিলাভ কর। আমি গৌরবের বিষয় বলিয়া জ্ঞান করি না। সেটা যে গৌরবের বিষয় নহে, সে কথা আমাকে আর-এক ব্যক্তি অনাবশ্বক স্পষ্ট ভাষায় স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল। পূর্বেই পাঠকগণ সংবাদ পাইয়াছেন, আমার স্ত্রীর জাঠতুতো বোনের বিবাহ হইয়াছে। তাহার স্বামীটা অত্যন্ত বর্বর দুর্বত্ত। স্ত্রীর প্রতি তাহার অত্যাচার অসহ । আমি এই পাষণ্ডের নির্দয়াচরণ লইয়া আত্মীয়সমাজে আলোচনা করিয়াছিলাম, সে কথা অনেক বড়ো হইয়া তাহার কানে উঠিয়াছিল। সে তাহার পর হইতে আমার প্রতি লক্ষ করিয়া সকলের কাছে বলিয়া বেড়াইতেছে যে, নিজের নামে হইতে আরম্ভ করিয়া শ্বশুরের নামে পর্যস্ত উত্তম-মধ্যম-অধম অনেকরকম থ্যাতির বিবরণ শাস্ত্রে লিখিয়াছে, কিন্তু নিজের স্ত্রীর খ্যাতিতে যশস্বী হওয়ার কল্পনা কবির মাথাতেও আসে নাই। এমন-সব কথা লোকের মুখে মুখে চলিতে আরম্ভ করিলে স্ত্রীর মনে তো দম্ভ জন্মিতেই পারে। বিশেষত বাবার একটা বদ অভ্যাস ছিল, নিঝরিণীর সামনেই তিনি আমাদের পরস্পরের বাংলাভাষাজ্ঞান লইয়া কৌতুক করিতেন। একদিন তিনি বলিলেন, “হরিশ যে বাংলা চিঠিগুলো লেখে তাহার বানানটা তুমি দেখিয়া দাও-না কেন, বউমা— আমাকে এক চিঠি লিখিয়াছে, তাহাতে সে জগদিন্দ্র’ লিখিতে দীর্ঘ ঈ বসাইয়াছে।” শুনিয়া বাবার বউমা নীরবে একটুখানি স্মিতহাস্ত করিলেন। আমিও কথাটাকে ঠাট। বলিয়৷ হাসিলাম, কিন্তু এরকম ঠাটা ভালো নয়।