পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২৮৩ হইতে মারীর মধ্যে ভাসাইয়া দিলেন কেন । আজ এই-ষে পেলব প্রাণটি ক্লিষ্ট হইয়। বিছানার উপরে পড়িয়া আছে, ইহার এই অল্প কয়দিনের আয়ুর মধ্যে এত বিপদের আঘাত, এত বেদনার ভার সহিল কী করিয়া, ধরিল কোথায়। যতীনই বা ইহার জীবনের মাঝখানে তৃতীয় আর-একটি সংকটের মতো কোথা হইতে আসিয়া জড়াইয়া পড়িল। রুদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাস যতীনের বক্ষোদ্বারে আঘাত করিতে লাগিল— কিন্তু সেই আঘাতের তাড়নায় তাহার হৃদয়ের তারে একটা সুখের মীড়ও বাজিয়া উঠিল। যে ভালোবাসা জগতে দুর্লভ, যতীন তাহা না চাহিতেই, ফাঙ্কনের একটি মধ্যাহ্নে একটি পূর্ণবিকশিত মাধবীমঞ্জুরির মতো অকস্মাং তার পায়ের কাছে আপনি আসিয়া খসিয়া পড়িয়াছে। যে ভালোবাসা এমন করিয়া মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত আসিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়ে, পৃথিবীতে কোন লোক সেই দেবভোগ্য নৈবেদ্যলাভের অধিকারী। যতীন কুড়ানির পাশে বসিয়া তাহাকে অল্প অল্প গরম দুধ খাওয়াইয়া দিতে লাগিল। খাইতে থাইতে অনেকক্ষণ পরে সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চোখ মেলিল । যতীনের মুখের দিকে চাহিয়া তাহাকে স্বদুর স্বপ্নের মতো যেন মনে করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। যতীন যখন তাহার কপালে হাত রাখিয়া একটুখানি নাড়া দিয়া কহিল, “কুড়ানি”— তখন তাহার অজ্ঞানের শেষ ঘোরটুকু হঠাৎ ভাঙিয়া গেল— যতীনকে সে চিনিল এবং তখনই তাহার চোখের উপরে বাষ্পকোমল আর-একটি মোহের আবরণ পড়িল। প্রথম-মেঘ-সমাগমে সুগম্ভীর আষাঢ়ের আকাশের মতো কুড়ানির কালে চোখদুটির উপর একটি যেন মৃদুরব্যাপী সজলস্নিগ্ধতা ঘনাইয়া আসিল। যতীন সকরুণ যত্বের সহিত কহিল, “কুড়ানি, এই দুধটুকু শেষ করিয়া ফেলো।” কুড়ানি একটু উঠিয়া বসিয়া পেয়ালার উপর হইতে যতীনের মুখে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া সেই দুধ টুকু ধীরে ধীরে খাইয়া ফেলিল । হাসপাতালের ডাক্তার একটিমাত্র রোগীর পাশে সমস্তক্ষণ বসিয়া থাকিলে কাজও চলে না, দেখিতেও ভালো হয় না। অন্তত্র কর্তব্য সারিবার জন্য যতীন যখন উঠিল তখন ভয়ে ও নৈরাখে কুড়ানির চোখদুটি ব্যাকুল হইয়া পড়িল ৷ যতীন তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে আশ্বাস দিয়া কহিল, “আমি আবার এখনই আসিব কুড়ানি, তোমার কোনো ভয় নাই।” যতীন কর্তৃপক্ষদিগকে জানাইল যে, এই নৃতন-আনীত রোগিনীর প্লেগ হয় নাই, সে না খাইয়া দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। এখানে অন্ত প্লেগরোগীর সঙ্গে থাকিলে তাহার পক্ষে বিপদ ঘটিতে পারে । বিশেষ চেষ্টা করিয়া যতীন কুড়ানিকে অন্যত্র লইয়া যাইবার অনুমতি লাভ করিল