পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ৪১৩ উপর ছিল সেটাও রহিল না। হঠাৎ জীবনটা ক্ষণকা এবং সংসারটা নিতান্তই ফাকি বলিয়। তাহার কাছে মনে হইতে লাগিল । এতদিন রসিক এই গ্রামের বনবাদগড়, রথতলা, রাধানাথের মন্দির, নদী, খেয়াঘাট, বিল, দিঘি, কামারপাড়া, ছুতারপাড়া, হাটবাজার সমস্তই আপনার আনন্দে ও প্রয়োজনে বিচিত্রভাবে অধিকার করিয়া লইয়াছিল। সব জায়গাতেই তাহার একটা একটা আডড ছিল, যেদিন যেখানে খুশি কখনো-বা একলা কখনো-বা দলবলে কিছু-না-কিছু লইয়া থাকিত। এই গ্রাম এবং থানাগড়ের বাবুদের বাড়ি ছাড়া জগতের আর যে কোনো অংশ তাহার জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় তাহ। সে কোনোদিন মনেও করে নাই। আজ এই গ্রামে তাহার মন আর কুলাইল না । দূর দূর বহুদূরের জন্ত তাহার চিত্ত ছট্‌ফট্‌ করিতে লাগিল। তাহার অবসর যথেষ্ট ছিল— বংশী তাহাকে খুব বেশিক্ষণ কাজ করাইত না । কিন্তু ওই একটুক্ষণ কাজ করিয়াই তাহার সমস্ত অবসর পর্যন্ত যেন বিস্বাদ হইয়া গেল ; এরূপ খণ্ডিত অবসরকে কোনো ব্যবহারে লাগাইতে তাহার ভালো লাগিল না । o NV এই সময়ে থানাগড়ের বাবুদের এক ছেলে এক বাইসিক্ল কিনিয়া আনিয়া চড় অভ্যাস করিতেছিল। রসিক সেটাকে লইয়া অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই এমন আয়ত্ত করিয়া লইল যেন সে তাহার নিজেরই পায়ের তলাকার একটা ভানা । কিন্তু কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ ! দূরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন তীক্ষ্ণ সুদর্শনচক্রের মতো অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়। ঝড়ের বাতাস যেন চাকার আকার ধারণ করিয়া উন্মত্তের মতো মানুষকে পিঠে করিয়া লইয়া ছোটে । রামায়ণ-মহাভারতের সময় মানুষে কখনো কখনো দেবতার অস্ত্র লইয়া যেমন ব্যবহার করিতে পাইত, এ যেন সেইরকম। রসিকের মনে হইল এই বাইসিকূল নহিলে তাহার জীবন বৃথা। দাম এমনই কী বেশি। একশো পচিশ টাকা মাত্র ! এই একশো পচিশ টাকা দিয়া মানুষ একটা নূতন শক্তি লাভ করিতে পারে— ইহা তো সস্তা। বিষ্ণুর গরুড়বাহন এবং স্বর্যের অরুণসারথি তো স্থষ্টিকর্তাকে কম ভোগ ভোগায় নাই, আর ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবার জন্য সমুদ্রমন্থন করিতে হইয়াছিল— কিন্তু এই বাইসিকূলটি আপন পৃথিবীজয়ী গতিবেগ স্তন্ধ করিয়া কেবল একশো পচিশ টাকার জন্তে দোকানের এক কোণে দেয়াল ঠেস দিয়া প্রতীক্ষা করিয়া আছে । ՀՀ|ՀԵ