পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 y bo } রবীন্দ্র-রচনাবলী লাগিল। অবশেষে উভয়পক্ষে সন্ধি যখন এতদূর অগ্রসর হইল যে সৌরভী রসিককে পান আনিয়া দিল তখন রসিক সেই কঁাখার আবরণ খুলিয়া সেটা আঙিনার উপর মেলিয়া দিল— সৌরভীর হৃদয়টি বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গেল। অবশেষে যখন রসিক বলিল “সৈরি, এ কাথা তোর জন্যই তৈরি করিয়াছি, এটা আমি তোকেই দিলাম,” তখন এতবড়ো অভাবনীয় দান কোনোমতেই সৌরভ স্বীকার করিয়া লইতে পারিল না । পৃথিবীতে সৌরভী কোনো দুর্লভ জিনিস দাবি করিতে শেখে নাই। গোপাল তাহাকে খুব ধমক দিল । মানুষের মনস্তত্বের সূক্ষ্মতা সম্বন্ধে তাহার কোনো বোধ ছিল না ; সে মনে করিল, লোভনীয় জিনিস লইতে লজ্জা একটা নিরবচ্ছিন্ন কপটতামাত্র। গোপাল ব্যর্থ কালব্যয় নিবারণের জন্য নিজেই কথাটা ভঁাজ করিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে রাখিয়া আসিল । বিচ্ছেদ মিটমাট হইয়া গেল । এখন হইতে আবার পূর্বতন প্রণালীতে তাহদের বন্ধুত্বের ইতিহাসের দৈনিক অনুবুত্তি চলিতে থাকিবে, দুটি বালকবালিকার মন এই আশায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। সেদিন পাড়ায় তাহার দলের সকল ছেলেমেয়ের সঙ্গেই রসিক আগেকার মতোই ভাব করিয়া লইল— কেবল তাহার দাদার ঘরে একবারও প্রবেশ করিল না। যে প্রৌঢ়া বিধবা তাহীদের বাড়িতে আসিয়া রাধিয়া দিয়া যায় সে আসিয়া যখন সকালে বংশীকে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কী রান্না হইবে”— বংশী তখন বিছানায় শুইয়া । সে বলিল, “আমার শরীর ভালো নাই, আজ আমি কিছু খাইব না— রসিককে ডাকিয়া তুমি খাওয়াইয়া দিয়ে।” স্ত্রীলোকটি বলিল, রসিক তাহাকে বলিয়াছে, সে আজ বাড়িতে খাইবে না— অন্যত্র বোধ করি তাহার নিমন্ত্রণ আছে। শুনিয়া বংশী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া গায়ের কাপড়টায় মাথা পর্যন্ত মুড়িয়া পাশ ফিরিয়া শুইল। রসিক ষেদিন সন্ধ্যার পর গ্রাম ছাড়িয়া সার্কাসের দলের সঙ্গে চলিয়া গেল সেদিন এমনি করিয়াই কাটিল। শীতের রাত্রি ; আকাশে আধখানি চাদ উঠিয়াছে। সেদিন হাট ছিল। হাট সারিয়া সকলেই চলিয়া গিয়াছে— কেবল যাহাদের দূর পাড়ায় বাড়ি, এখনো তাহারা মাঠের পথে কথা কহিতে কহিতে চলিয়াছে। একখানি বোঝাইশূন্ত গোরুর গাড়িতে গাড়োয়ান র্যাপার মুড়ি দিয়া নিগ্রামগ্ন ; গোরু দুটি আপন মনে ধীরে ধীরে বিগ্রামশালার দিকে গাড়ি টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। গ্রামের গোয়ালম্বর হইতে খড়জালানো ধোয়া বায়ুহীন শীতরাত্রে হিমভারাক্রান্ত হইয়া স্তরে স্তরে বঁাশঝাড়ের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া আছে। রসিক যখন প্রান্তরের প্রান্তে গিয়া পৌছিল, যখন অস্ফুট চন্দ্রালোকে তাহদের গ্রামের ঘন গাছগুলির নীলিমাও আর দেখা যায় না, তখন রসিকের মনটা কেমন করিয়া উঠিল। তখনো ফিরিয়া আসার পথ কঠিন ছিল না,