পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সূচনা লিনী নাটিকার উৎপত্তির একটা বিশেষ ইতিহাস আছে, সে স্বপ্নঘটিত । কবিকঙ্কণকে দেবী স্বপ্নে আদেশ করেছিলেন তার গুণকীর্তন করতে । আমার স্বপ্নে দেবীর আবির্ভাব ছিল না, ছিল হঠাৎ মনের একটা গভীর আত্মপ্রকাশ ঘুমন্ত বুদ্ধির সুযোগ নিয়ে । তখন ছিলুম লণ্ডনে। নিমন্ত্রণ ছিল প্রিমরোজ হিলে তারক পালিতের বাসায় । প্রবাসী বাঙালিদের প্রায়ই সেখানে হত জটলা, আর তার সঙ্গে চলত ভোজ । গোলেমালে রাত হয়ে গেল। র্যাদের বাড়িতে ছিলুম, অত রাত্রে দরজার ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে হঠাৎ চমক লাগিয়ে দিলে গৃহস্থ সেটাকে দুঃসহ বলেই গণ্য করতেন ; তাই পালিত সাহেবের অনুরোধে তার ওখানেই রাত্রিযাপন স্বীকার করে নিলুম। বিছানায় যখন শুলুম তখনো চলছে কলরবের অন্তিম পর্ব, আমার ঘুম ছিল আবিল হয়ে । এমন সময় স্বপ্ন দেখলুম, যেন আমার সামনে একটা নাটকের অভিনয় হচ্ছে । বিষয়টা একটা বিদ্রোহের চক্রান্ত । দুই বন্ধুর মধ্যে এক বন্ধু কর্তব্যবোধে সেটা ফাস করে দিয়েছেন রাজার কাছে। বিদ্রোহী বন্দী হয়ে এলেন রাজার সামনে । মৃত্যুর পূর্বে তীর শেষ ইচ্ছা পূৰ্ণ করবার জন্যে তার বন্ধুকে যেই তার কাছে এনে দেওয়া হল দুই হাতের শিকল তার মাথায় মেরে বন্ধুকে দিলেন ভূমিসাৎ করে । জেগে উঠে যেটা আমাকে আশ্চর্য ঠেকাল সেটা হচ্ছে এই যে, আমার মনের একভাগ নিশ্চেষ্ট শ্রোতামাত্র, অন্যভাগ বুনে চলেছে একখানা নাটক । স্পষ্ট হােক অস্পষ্ট হােক একটা কথাবার্তার ধারা গল্পকে বহন করে চলেছিল । জেগে উঠে সে আমি মনে আনতে পারলুম না । পালিত সাহেবকে মনের ক্রিয়ার এই বিস্ময়কর।তা জানিয়েছিলুম । তিনি এটাতে বিশেষ কোনো ঔৎসুক্য বোধ করলেন না । কিন্তু অনেক কাল এই স্বপ্ন আমার জাগ্ৰত মনের মধ্যে সঞ্চরণ করেছে । অবশেষে অনেক দিন পরে এই স্বপ্নের স্মৃতি নাটিকার আকার নিয়ে শান্ত হল । বোধ করি এই নাটিকায় আমার রচনার একটা কিছু বিশেষত্ব ছিল, সেটা অনুভব করেছিলুম। যখন দ্বিতীয় বার ইংলণ্ডে বাসকালে এর ইংরেজি অনুবাদ কোনো ইংরেজ বন্ধুর চোখে পড়ল । প্রথম দেখা গেল এটা আটিস্ট রোটেনস্টাইনের মনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে । কখনো কখনো এটাকে তার ঘরে অভিনয় করবার ইচ্ছেও তার হয়েছিল । আমার মনে হল, এই নাটকের প্রধান চরিত্রগুলি তার শিল্পী-মনে মূর্তিরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার পরে একদিন ট্ৰেভেলিয়ানের মুখে এর সম্বন্ধে মন্তব্য শুনলুম। তিনি কবি এবং গ্ৰীক সাহিত্যের রসজ্ঞ । তিনি আমাকে বললেন, এই নাটকে তিনি গ্রীক নাট্যকলার প্রতিরূপ দেখেছেন । তার অর্থ কী তা আমি সম্পূর্ণ বুঝতে পারি নি, কারণ যদিও কিছু কিছু তর্জমা পড়েছি, তবু গ্ৰীক নাট্য আমার অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য, ব্যাপ্তি ও ঘাতপ্ৰতিঘাত প্ৰথম থেকেই আমাদের মনকে অধিকার করেছে । মালিনীর নাট্যরূপ সংযত সংহত এবং দেশকালের ধারায় অবিচ্ছিন্ন । এর বাহিরের রূপায়ণ সম্বন্ধে যে মত শুনেছিলুম এ হচ্ছে তাই । কবিতার মর্মকথাটি প্রথম থেকেই যদি রচনার মধ্যে জেনেশুনে বপন করা না হয়ে থাকে। তবে কবির কাছেও সেটা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে দেরি লাগে, আজ আমি জানি মালিনীর মধ্যে কী কথাটি লিখতে লিখতে উদ্ভাবিত হয়ে ছিল গৌণরূপে ঈষৎগোচর । আসল কথা, মনের একটা সত্যকার বিস্ময়ের আলোড়ন ওর মধ্যে দেখা দিয়েছে। আমার মনের মধ্যে ধর্মের প্রেরণা তখন গৌরীশংকরের উতুঙ্গ শিখরে শুভ্র নির্মল তুষারপুঞ্জের মতো নির্মল নির্বিকল্প হয়ে স্তব্ধ ছিল না, সে বিগলিত হয়ে মানবলোকে বিচিত্র