পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি NSO A Sd দাড়াইল। তিনি কহিলেন, “লজ্জা কী মা। বাটা ঐ ওঁদের সামনে রাখো।” বালিকা নত হইয়া কম্পিতহস্তে পানের বাটা অতিথিদের আসন-পার্শ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিল। বারান্দার পশ্চিম-প্ৰান্ত হইতে সূর্যস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেল। সেই অবকাশে মহেন্দ্ৰ সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল । বালিকা তখনি চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে অনুকুলবাবু কহিলেন, “একটু দাড়া চুনি। বিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটাে ভাই অপূর্বর কন্যা। সে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ। নাই।” বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিল। অনাথার দিকে আর-এক বার চাহিয়া দেখিল । কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত না। আত্মীয়েরা বলিত, “এই বারো-তেরো হইবে।” অর্থাৎ চৌদ্দ-পনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুষ্ঠিত ভীরু ভাবে তাহার নবযৌবনারম্ভকে সংযত সংবৃত করিয়া রাখিয়াছে। আদ্ৰচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী।” অনুকুলবাবু উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো মা, তোমার নাম বলো।” বালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশ-পালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার নাম । আশালতা ।” আশা ! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো কোমল। অনাথ আশা ! দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মহেন্দ্ৰ কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ে না।” বিহারী তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার মাসিমাকে মনে পড়ে ; বোধ হয় আমনি লক্ষ্মী হইবে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না।” বিহারী কহিল, “না, বোধ হয় সহ্য করিতে পারিব।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়া। তোমার বোঝা নাহয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লই। কী বল ।” বিহারী গভীরভাবে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “মহিনদা, সত্য বলিতেছ? এখনো ঠিক করিয়া বলো। তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন— তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সৰ্ব্বদাই কাছে রাখিতে পরিবেন।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ ? সে হইলে অনেক কাল আগে হইয়া যাইত।” বিহারী অধিক আপত্তি না করিয়া চলিয়া গেল, মহেন্দ্ৰও সোজা পথ ছাড়িয়া দীর্ঘ পথ ধরিয়া বহুবিলম্বে ধীরে ধীরে বাড়ি গিয়া পৌছিল। মা তখন লুচিভাজা —ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন, কাকী তখনাে তাহার বােনঝির নিকট হইতে ফেরেন মহেন্দ্ৰ এক নির্জন ছাদের উপর গিয়া মাদুর পাতিয়া শুইল। কলিকাতার হর্ম্যশিখরপুঞ্জের উপর শুক্লসপ্তমীর অর্ধচন্দ্র নিঃশব্দে আপন অপরূপ মায়ামন্ত্র বিকীর্ণ করিতেছিল। মা যখন খাবার খবর দিলেন, মহেন্দ্ৰ অলসস্বরে কহিল, “বেশ আছি, এখন আর উঠিতে পারি না।” মা কহিলেন, “এইখানেই আনিয়া দিই-না ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আজ আর খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।” মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় খাইতে গিয়াছিলি।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “ সে অনেক কথা, পরে বলিব ।” মহেঞ্জের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারে অভিমানিনী মাতা কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত t