পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\Str8 রবীন্দ্র-রচনাবলী রাজলক্ষ্মী সেদিন মধ্যাহ্নে সেই সিংহাসনে এই নূতন-আগত পরের মেয়েকে এমন চিরাভ্যস্তবৎ স্পর্ধার সহিত বসিয়া থাকিতে দেখিয়া দুঃসহ বিস্ময়ে নীচে নামিয়া আসিলেন। নিজের চিত্তদাহে অন্নপূর্ণাকে দগ্ধ করিতে গেলেন। কহিলেন, “ওগো, দেখো গে, তোমার নবাবের পুত্রী নবাবের ঘর হইতে কী শিক্ষা লইয়া আসিয়াছেন। কর্তারা থাকিলে আজ- ” অন্নপূর্ণ কাতর হইয়া কহিলেন, “দিদি, তোমার বউকে তুমি শিক্ষা দিবে, শাসন করিবে, আমাকে কেন বলিতেছ।” রাজলক্ষ্মী ধনুষ্টংকারের মতো বাজিয়া উঠিলেন, “আমার বউ ? তুমি মন্ত্রী থাকিতে সে আমাকে গ্রাহ্য করিবে !” তখন অন্নপূর্ণ সশব্দপদক্ষেপে দম্পতিকে সচকিত সচেতন করিয়া মহেন্দ্রের শয়নগৃহে উপস্থিত হইলেন। আশাকে কহিলেন, “তুই এমনি করিয়া আমার মাথা হেঁট করিবি পোড়ারমুখী ? লজ্জা নাই, শরম নাই, সময় নাই, অসময় নাই, বৃদ্ধা শাশুড়ির উপর সমস্ত ঘরকন্না চাপাইয়া তুমি এখানে আরাম করিতেছ? আমার পোড়াকপাল, আমি তোমাকে এই ঘরে আনিয়াছিলাম!” বলিতে বলিতে র্তাহার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, আশাও নতমুখে বস্ত্ৰাঞ্চল খুঁটিতে খুঁটিতে নিঃশব্দে দাড়াইয়া কাদিতে লাগিল। মহেন্দ্ৰ কহিল, “কাকী, তুমি বউকে কেন অন্যায় ভৎসনা করিতেছ। আমিই তো উহাকে ধরিয়া রাখিয়াছি।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “সে কি ভালো কাজ করিয়াছ ? ও বালিকা, অনাথা, মার কাছ হইতে কোনোদিন কোনো শিক্ষা পায় নাই, ও ভালোমন্দর কী জানে। তুমি উহাকে কী শিক্ষা দিতেছ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “এই দেখো, উহার জন্যে স্লেট খাতা বই কিনিয়া আনিয়াছি। আমি বউকে লেখাপড়া শিখাইব, তা লোকে নিন্দাই করুক আর তোমরা রাগই কর।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “তাই কি সমস্ত দিনই শিখাইতে হইবে। সন্ধ্যার পর এক-আধা ঘণ্টা পড়ালেই তো ঢের হয় ।” মহেন্দ্র। অত সহজ নয় কাকী, পড়াশুনায় একটু সময়ের দরকার হয়। অন্নপূর্ণ বিরক্ত হইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। আশাও ধীরে ধীরে তাহার অনুসরণের উপক্ৰম করিল— মহেন্দ্র দ্বার রোধ করিয়া দাড়াইল, আশার করুণ সজল নেত্রের কাতর অনুনয় মানিল না। কহিল, “রোসো, ঘুমাইয়া সময় নষ্ট করিয়াছি, সেটা পোষাইয়া লইতে হইবে।” এমন গভীরপ্রকৃতির শ্রদ্ধেয় মৃঢ় থাকিতেও পারেন যিনি মনে করিবেন, মহেন্দ্ৰ নিদ্রাবেশে পড়াইবার সময় নষ্ট করিয়াছে ; বিশেষরূপে তাহাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক যে, মহেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে অধ্যাপনকার্য যেরূপে নির্বাহ হয়, কোনো স্কুলের ইন্সপেক্টর তাহার অনুমোদন করিবেন। | | আশা তাহার স্বামীকে বিশ্বাস করিয়াছিল ; সে বস্তুতই মনে করিয়াছিল লেখাপড়া শেখা তাহার পক্ষে নানা কারণে সহজ নহে বটে, কিন্তু স্বামীর আদেশাবশত নিতান্তই কর্তব্য। এইজন্য সে প্ৰাণপণে অশান্ত বিক্ষিপ্ত মনকে সংযত করিয়া আনিত, শয়নগৃহের মেঝের উপর ঢালা বিছানার এক পার্শ্বে অত্যন্ত গভীর হইয়া বসিত এবং পুঁথিপত্রের দিকে একেবারে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মাথা দুলাইয়া মুখস্থ করিতে আরম্ভ করিত। শয়নগৃহের অপর প্রান্তে ছোটাে টেবিলের উপর ডাক্তারি বই খুলিয়া দেখিতেছেন। দেখিতে দেখিতে হঠাৎ ডাক্তারি বই বন্ধ করিয়া মহেন্দ্ৰ আশার ডাক-নাম ধরিয়া ডাকিল, “চুনি।” চকিত আশা মুখ তুলিয়া চাহিল। মহেন্দ্ৰ কহিল, “বইটা আনো দেখি, দেখি কোনখানটা পড়িতেছ।” আশার ভয় উপস্থিত হইল, পাছে মহেন্দ্র পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার আশা অল্পই ছিল। কারণ, চারুপাঠের চারুত্ব-প্রলোভনে তাহার অবাধ্য মন কিছুতেই বশ মানে না ; বল্মীক সম্বন্ধে