পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি ○ケa মহেন্দ্ৰ কহিল, “কাকী যেখানে গেছেন, আমরাও সেইখানে যাইব, দেখি, মা কাহাকে লইয়া ঝগড়া করেন।” বলিয়া অনাবশ্যক শোরগোল করিয়া জিনিসপত্র বাধাবাধি মুটে-ডাকাডাকি শুরু করিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিলেন। ধীরে ধীরে মহেন্দ্রের কাছে আসিয়া শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাইতেছিস ।” মহেন্দ্ৰ প্ৰথমে কোনো উত্তর করিল না। দুই-তিন বার প্রশ্নের পর উত্তর করিল,“কাকীর কাছে যাইব ।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোদের কোথাও যাইতে হইবে না, আমিই তোর কাকীকে আনিয়া দিতেছি।” বলিয়া তৎক্ষণাৎ পালকি চডিয়া অন্নপূর্ণার বাসায় গেলেন। গলায় কাপড় দিয়া জোড়হাত করিয়া কহিলেন, “প্ৰসন্ন হও মেজেবিউ, মাপ করো।” অন্নপূর্ণ শশব্যস্ত হইয়া রাজলক্ষ্মীর পায়ের ধুলা লইয়া কাতরস্বরে কহিলেন, “দিদি, কেন আমাকে অপরাধী করিতেছ। তুমি যেমন আজ্ঞা করিবে তাই করিব।” বলিতে বলিতে অভিমানে ক্ৰোধে ধিককারে তিনি কঁাদিয়া ফেলিলেন। দুই জা। বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। তখনো বৃষ্টি পড়িতেছে। অন্নপূর্ণ মহেন্দ্রের ঘরে যখন গেলেন তখন আশার রোদন শান্ত হইয়াছে এবং মহেন্দ্ৰ নানা কথার ছলে তাহাকে হাসাইবার চেষ্টা করিতেছে। লক্ষণ দেখিয়া বোধ হয় বাদলার সন্ধ্যাটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ না যাইতেও পারে। অন্নপূর্ণা কহিলেন, “চুনি, তুই আমাকে ঘরেও থাকতে দিবি না, অন্য কোথাও গেলেও সঙ্গে লাগিবি ? আমার কি কোথাও শান্তি নাই ?” আশা অকস্মাৎ বিদ্ধ মৃগীর মতো চকিত হইয়া উঠিল। মহেন্দ্ৰ একান্ত বিরক্ত হইয়া কহিল, “কোন কাকী, চুনি তোমার কী করিয়াছে।” অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বউ-মানুষের এত বেহায়াপনা দেখিতে পারি না বলিয়াই চলিয়া গিয়াছিলাম, আবার শাশুড়িকে কাদাইয়া কেন আমাকে ধরিয়া আনিল পোড়ারমুখী।” জীবনের কবিত্ব-অধ্যায়ে মা খুড়ী যে এমন বিয়, তাহা মহেন্দ্ৰ জানিত না। পরদিন রাজলক্ষ্মী বিহারীকে ডাকাইয়া কহিলেন, “বাছা, তুমি একবার মহিনকে বলো, অনেক দিন দেশে যাই নাই, আমি বারাসতে যাইতে চাই।” বিহােরা কহিল,“অনেক দিনই যখন যান নাই তখন আর নাই গেলেন। আচ্ছা, আমি মহিনদাকে বলিয়া দেখি, কিন্তু সে যে কিছুতেই রাজি হইবে তা বোধ হয় না।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তা, জন্মস্থান দেখিতে ইচ্ছা হয় বটে। কিন্তু বেশি দিন মার সেখানে না থাকাই ভালো- বর্ষার সময় জায়গাটা ভালো নয়।” মহেন্দ্ৰ সহজেই সম্মতি দিল দেখিয়া বিহারী বিরক্ত হইল। কহিল, “মা একলা যাইবেন, কে তাহাকে দেখিবো। বোঠানকেও সঙ্গে পাঠাইয়া দাও-না !” বলিয়া একটু হাসিল। বিহারীর গৃঢ় ভৎসনায় মহেন্দ্ৰ কুষ্ঠিত হইয়া কহিল, “তা বুঝি আর পারি না।” কিন্তু কথাটা ইহার অধিক আর অগ্রসর হইল না। এমনি করিয়াই বিহারী আশার চিত্ত বিমুখ করিয়া দেয়, এবং আশা তাহার উপরে বিরক্ত হইতেছে মনে করিয়া সে যেন একপ্রকারের শুষ্ক আমোদ অনুভব করে। বলা বাহুল্য, রাজলক্ষ্মী জন্মস্থান দেখিবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক ছিলেন না। গ্ৰীষ্মে নদী যখন কমিয়া আসে তখন মাঝি যেমন পদে পদে লাগি ফেলিয়া দেখে কোথায় কত জল, রাজলক্ষ্মীও তেমনি ভাবান্তরের সময় মাতাপুত্রের সম্পর্কের মধ্যে লগি ফেলিয়া দেখিতেছিলেন। তাহার বারাসতে যাওয়ার প্রস্তাব যে এত শীঘ এত সহজেই তল পাইবে, তাহা তিনি আশা করেন নাই। মনে মনে কহিলেন,