পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি \òbrእS রাজলক্ষ্মী বলেন, “এমন করিলে যে তোমার অসুখ করিবে মা।” বিনোদিনী নিজের প্রতি নিরতিশয় তাচ্ছিল্য প্রকাশ করিয়া বলে, “আমাদের দুঃখের শরীরে অসুখ কুবেল পুলিম। আহা কতদিন পরে জন্মভূমিতে আসিয়াছ, এখানে কী আছে, কী দিয়া তােমাকে আদর করিব।” বিহারী দুইদিনে পাড়ার কর্তা হইয়া উঠিল। কেহ তার কাছে রোগের ঔষধ কেহ-বা মোকদ্দমার ধরে, কেহ-বা তাহার কাছে দরখাস্ত লিখাইয়া লয়। বৃদ্ধদের তাসপাশার বৈঠক হইতে বাগদিদের তাড়িপানসভা পর্যন্ত সর্বত্র সে তাহার সকৌতুক কৌতুহল এবং স্বাভাবিক হৃদ্যতা লইয়া যাতায়াত করিত— কেহ তাহাকে দূর মনে করিত না, অথচ সকলেই তাহাকে সম্মান করিত। বিনোদিনী এই অস্থানে পতিত কলিকাতার ছেলেটির নির্বাসনদণ্ডও যথাসাধ্য লঘু করিবার জন্য কে তাহার ঘরটিকে প্রত্যেক বার পরিপাটি পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, একটি কাসার গ্রাসে দু-চারটি ফুল এবং পাতার তোড়া সাজাইয়াছে এবং তাহার গদির এক ধারে বঙ্কিম ও দীনবন্ধুর গ্রন্থাবলী গুছাইয়া রাখিয়াছে। গ্রন্থের ভিতরের মলাটে মেয়েলি অথচ পাকা অক্ষরে বিনোদিনীর নাম লেখা। পল্লীগ্রামের প্রচলিত আতিথ্যের সহিত ইহার একটু প্ৰভেদ ছিল। বিহারী তাহারই উল্লেখ করিয়া প্ৰশংসাবাদ করিলে রাজলক্ষ্মী কহিতেন, “এই মেয়েকে কিনা তোরা অগ্রাহ্য করিলি।” বিহারী হাসিয়া কহিত, “ভালো করি নাই মা, ঠকিয়াছি। কিন্তু বিবাহ না করিয়া ঠিক ভালো, বিবাহ করিয়া ঠকিলেই মুশকিল।” রাজলক্ষ্মী কেবলই মনে করিতে লাগিলেন, “আহা, এই মেয়েই তো আমার বধু হইতে পারিত। কেন হইল না ।” রাজলক্ষ্মী কলিকাতায় ফিরিবার প্রসঙ্গমাত্র উত্থাপন করিলে বিনোদিনীর চোখ ছলছল করিয়া উঠিত। সে বলিত, “পিসিমা, তুমি দুদিনের জন্যে কেন এলে ! যখন তোমাকে জানিতাম না, দিন তো একরকম করিয়া কাটিত । এখন তোমাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া থাকিব ।” রাজলক্ষ্মী মনের আবেগে বলিয়া ফেলিতেন, “মা, তুই আমার ঘরের বউ হলি নে কেন, তা হইলে তোকে বুকের মধ্যে করিয়া রাখিতাম।” সে কথা শুনিয়া বিনোদিনী কোনো ছুতায় লজ্জায় সেখান হইতে উঠিয়া যাইত। রাজলক্ষ্মী কলিকাতা হইতে একটা কাতর অনুনয়পত্রের অপেক্ষায় ছিলেন। তাহার মহিন জন্মাবধি কখনো এতদিন মাকে ছাড়িয়া থাকে নাই- নিশ্চয় এতদিনে মারি বিচ্ছেদ তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। রাজলক্ষ্মী তাহার ছেলের অভিমান এবং আবদারের সেই চিঠিখানির জন্য তৃষিত হইয়া ছিলেন। বিহারী মহেন্দ্রের চিঠি পাইল। মহেন্দ্ৰ লিখিয়াছে, “মা বোধ হয় অনেক দিন পরে জন্মভূমিতে গিয়া বেশ সুখে আছেন।” রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, “আহা, মহেন্দ্ৰ অভিমান করিয়া লিখিয়াছে। সুখে আছেন। হতভাগিনী মা নাকি মহেন্দ্ৰকে ছাড়িয়া কোথাও সুখে থাকিতে পারে।” “ও বিহারী, তার পরে মহিন কী লিখিয়াছে, পড়িয়া শোনা-না বাছা ।” বিহারী কহিল, “তার পরে কিছুই না মা।” বলিয়া চিঠিখানা মুঠার মধ্যে দলিত করিয়া একটা বহির মধ্যে পুরিয়া ঘরের এক কোণে ধাপ করিয়া ফেলিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী কি আর স্থির থাকিতে পারেন। নিশ্চয়ই মহিন মার উপর এমন রাগ করিয়া লিখিয়াছে যে, বিহারী তাহাকে পড়িয়া শোনাইল না। বাছুর। যেমন গাভীর স্তনে আঘাত করিয়া দুগ্ধ এবং বাৎসল্যের সঞ্চার করে, মহেন্দ্রের রাগ তেমনি আঘাত করিয়া তাহার অবরুদ্ধ বাৎসল্যাকে উৎসারিত করিয়া দিল। তিনি মহেন্দ্ৰকে ক্ষমা